লেখক পরিচিতিঃ সৈকত হাবিরের সৃজনচর্চার সূচনা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। কবিতা ও গদ্য উভয় মাধ্যমেই সক্রিয় শক্তিমান। সৃজনশীলতা, সাংগঠনিকতা এবং সাংবাদিকতা-তিন ক্ষেত্রেই তার পদচারনা। ১৯৯৩ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ছোটকাগজ প্রতিশিল্প দেশে ছোটকাগজ আন্দোলনে ব্যতিক্রমী ও সাহসী উচ্চারন। কবিতার বাইরে তার প্রধান আগ্রহের অঞ্চল জীবনানন্দের সৃষ্টিজগত ও বিশ শতকের কবিতা। তিনি জন্মগ্রহন করেছেন ১৯৭৩ সালে, দাউদকান্দি, কুমিল্লা জেলাতে। ভালোবাসের বিচিত্র বিষয়ে পড়াশুনা আর ভ্রমন করতে। এর মধ্যেই তার বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, কবিতা (শহর যৌবন ও রাত্রি, আমরা কেবলই চায়ের টেবিলে ঝড়), প্রবন্ধ (কবিতার ডানা), গবেষনা সম্পাদনা (বনলতা সেনঃ ষাট বছরের পাঠ, বুদ্ধিজীবিঃইতিহাস অনুসন্ধান ও আত্মপাঠ)।
কবি কবিতা ও কথা: বইটি প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ২০১৩ সালে। প্রচ্ছদ করেছেন আজহার ফরহাদ। চার অংশে মোট ২০টি প্রবন্ধ নিয়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। লেখক খুবই সহজবোধ ভাষা ব্যবহার করে বইটি সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন। অনেকটা গল্প বলার ঢঙে কথা বলেছেন পাঠকের সাথে। পাঠক খুব সহজেই বইয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন ভাষাগত সীমাবদ্ধতা না থাকার কারনে অর্থাৎ সাধারন পাঠকের যেমন শব্দ ভীতি থাকে এখানে সে ধরনের কোন অনুভুতি কাজ করবে না ফলে মনের আনন্দে বইটি পড়তে পারবেন সকলেই।
১। মুল্যায়ন ও তর্পণ
• অশেষ রবীন্দ্রনাথ, প্রয়োজনের রবীন্দ্রনাথ
• বরীন্দ্রগানঃ হৃদয়ে আমার প্রকাশ হলো...
• জন্ম শতবর্ষে বুদ্ধদেব বসুঃ আশ্চর্য চির নতুন শিক্ষক
• জীবনানন্দ বিষয়েঃ ভুমেন্দ্র গুহর সঙ্গে
• শামসুর রহমানঃ কবির মুর্তি
• নাসির আলি মামুনঃ তার মুখবিশ্ব
২। কবিতা
• কবিতার সঙ্গে পথ হাটা
• কবিতার জন্য অপেক্ষা
• বনলতা সেনঃ চির রহস্যময়ীর সন্ধানে
• কবি কাম ও নিশিঃ নির্মলেন্দু গুণের নিশিকাব্য
• আলাপঃ কবিতা ও মিডিয়া বিষয়ে
৩। সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতি
• শিল্পীর দায় ও সমাজ
• নৈরাজ্যের ব্যাকরণ ও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি
• ছোটকাগজের ব্যক্তিত্ব পুনরুদ্ধার করা দরকার
• একুশের বইমেলা হউক চৈতন্যের সেতু
• প রস্কারটা যদি ”পরিস্কার” হতো
৪। জীবন প্রকৃতি পরিবেশ
• নিসর্গ, আমাদের হারানোর স্বর্গ
• বর্ষাঃ ভেতরে বাহিরে
• জ্যোৎসার দৃশ্যাবলি
•আমার শহরঃ স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের
সবগুলো প্রবন্ধ লিখেছেন কথা বলার মতো করে, সহজ, নির্ভার কিন্তু তীর্যক স্টাইলে। নিজের বিশ্বাস ও উপলব্ধিকে প্রকাশ করেছেন নির্ভয়ে, কোন ভনিতা বা পান্ডিত্যের কোষ্ঠকাঠিন্য ছাড়াই। চার পর্বের প্রবন্ধগুলো নানা বিষয়ের সমাহার যার বিস্তার রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রহমান থেকে শুরু করে কবি ও কবিতা, সমাজ ও সংস্কৃতি, ঋতু ও পরিবেশ এবং বুদ্ধিবৃত্তি পর্যন্ত।
একজীবনে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শেষ করা যায় না, সম্পুর্ন রবীন্দ্রনাথের সাথে বোঝাপড়ার মতো পাঠ বড় বেশি পরমায়ু দাবি করে, সেই তুলনায় আমাদের জীবন বড় নির্দয়ভাবে হ্স্ব। রবীন্দ্রনাথের ভেতর যেমন আছেন অনেক রবীন্দ্রনাথ, আবার আমাদের প্রত্যেকেরই আছেন নিজ নিজ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের যেমন পূর্ণতা রয়েছে তেমনি আছে খন্ড খন্ড চিত্র, আমরা প্রত্যেকেই বেছে নিতে পারি আমাদের মতো করে নিজস্ব রবীন্দ্রেনাথকে। লেখক এভাবেই তার উপলব্ধি, তার অনুভবকে ব্যাক্ত করেছেন নিজস্ব এক স্টাইলে।
লেখক নিজে কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করেছেন তার লিখনিতে- আমার এক রবীন্দ্রনাথ আছেন, অন্তর্গত, গভীর এবং ব্যক্তিগত এক রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সে কোন স্থিরমূর্তি রবীন্দ্রনাথ নয়। সে এক বিস্তৃত বৃক্ষ হয়ে আমার ভেতরে হাজার বছরের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। আমি শুধু তার ডালে ও শাখায় উড়ে ও ঘুরে বেড়াই, কখনোই চূড়া ছুঁতে পারি না। অন্যদিকে এই বৃক্ষের এত পত্রালি এবং এসবের ভেতর এতো এতো বিস্ময়, মুগ্ধতা, সত্য, সুন্দর আর চিন্তা, বাস্তব, দৃষ্টি ছড়ানো যে, তা যেন হয়ে আছে কালের এক একটি পৃষ্ঠা, তাকে বড় গহন-গভীর করে পাঠ করে অস্তিত্বের অংশ করে নিতে হয়।
বুদ্ধদেব বসুকে আবিস্কার করেছেন ভিন্ন এক মাত্রায়, যিনি আমাদের এতোটাই ঋণী করে রেখেছেন যে, তার জন্মশতবর্ষে এসে তার উত্তরসূরী হিসেবে এ কথা সহজভাবেই স্বীকার করে নিতে হয়, তার ঋণ শোধ করার যোগ্যাতা আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। গ্রন্থটিকে লেখক, এভাবেই কবি জীবনানন্দ, কবি শামসুর রহমানকে আমাদের কাছে পরিচিত করে তুলেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে, সচরাচর আমাদের চেনা চোখকে ভিন্নদিকে সরিয়ে নিয়ে।
লেখক, কবি ও কবিতা সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, কবির সঙ্গী হিসেবে কবিতা নাকি কবিতার সঙ্গী হিসেবে কবি? দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কটা কিংবা ভ্রমনটা খুব সুখের নাকি তিক্ততার? মাইকেল মধুসুদন দত্ত, জীবনানন্দ দাস, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শামীম কবির……আমাদের সামনে এমন অজস্র নুতন ও পুরাতন উদাহরন ছড়ানো আছে, যারা কবিতার সঙ্গে পথ হাটতে গীয়ে ক্রমাগত নিজেকে নিঃশেষ কিংবা বিনাশ করেছেন। একজন কবি কি কবিতাকে অপেক্ষা করায় তার পূর্নতা পাবার জন্য নাকি কবিতাই একজন কবিকে দীর্ঘক্ষন, এমনকি সারাজীবন ব্যাপী অপেক্ষা করায়, নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক প্রশ্ন।
কবি জীবনানন্দ দাসের “বনলতা সেন” কবিতাটি কেন এতো জনপ্রিয়তা? কবিতাটির দুরগামিতা এবং রহস্যময়তাই কি এর মুল কারন? কবিতাটিকে লেখ্ক নুতন ভাবে যেন বা আবিস্কার করেছেন, বিশ্লেষন করেছেন। আসলে বনলতা সেন কে? প্রশ্নটি পাঠকের মনে বারবারই ঘুরপাক খায়। আসলেই বনলতা সেন ছিলেন মানবী কেউ নাকি এ শুধু কবির কল্পনা?
লেখক গ্রন্থটিকে, কবিতার ফ্রেম থেকে আলোচনা, পাঠকের মনে নানা প্রশ্নের বিশ্লেষন সহ নানা তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন কিন্তু নিজের একটা স্টাইল সমৃদ্ধ লেখনির মাধ্যমে। সব মিলিয়ে কবিতা সম্পর্কিত এতো সহজ এবং সরল ভাষায় প্রবন্ধ খুব একটা দেখা যায় না। সর্বশ্রেনী এবং পেশা’র পাঠকের কাছে কবিতার দুর্বোধ্যতা কাটিয়ে তোলার এক অনুপম প্রয়াস।