লেখক পরিচিতিঃ লেখম মুহম্মদ ইমদাদ জন্মগ্রহন করেছেন ১৯৭৮ সালে মউলোভীবাজার, বাংলাদেশ। পড়াশুনা করেছেন শাজজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও লোক প্রশাসন বিভাগে। বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন। অনুবাদ, কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখছেন নিয়মিত। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ (অন্ধ পৃথিবীর জানালাগুলো, নদীমাতৃক পৃথিবী, মেঘমাতৃক আকাশ), অনুবাদগ্রন্থ ( চূর্ণ চিন্তন, চৈতন্য, দূরাগত স্বর, আর্থার শোপেনহাওয়ারের কথাগুলি) এবং কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ (আধুনিক কবিতা-বিষাদবৃক্ষের ফুল ও অন্যান্য প্রবন্ধ) প্রকাশিত হয়েছে।
আধুনিক কবিতা-বিষবৃক্ষ্যের ফুল ও অন্যান্য প্রবন্ধ: বইটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশনী,২০১৫ সালে একুশে বইমেলায়।। প্রচ্ছদ করেছেন তোউহিন হাসান। মোট ২০টি প্রবন্ধ নিয়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবং সবগুলো প্রবন্ধ বিষয়ভিত্তিক করে ৬টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে।
১।
• লোকান্তরিত সব রূপসী নারীঃ আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে
• আধুনিক কবিতা বিষবৃক্ষের ফুল
• সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা
২।
• রবীন্দ্রনাথ
৩।
• পাঠক ও কবিতা
• শব্দ হয়ে যায় আমাদের,আমরা হয়ে যাই শব্দ
৪
• আদিম দেবতারা (জীবনানন্দ দাস)
• বুদ্ধদেব বসুর শীতরাত্রির প্রার্থনা
• প্রেমে পড়া পুরুষের গান (বুদ্ধবেদ বসু)
• বোধ (শংখ ঘোষ)
• পালকের ছায়া (তপোধির ভট্রাচার্য)
• প্রতিবেশী (সাজ্জাদ শরীফ)
৫।
• কবির কথা
• কবিতার জন্ম, চিত্ত কাঁপানো ভাষার উদ্ভোধন
• কবি, তোমার বাজ্যের কোন শেষ নেই
• রক্তে যে উঠে-দাঁড়াবার বন্দনা
• উঠে দাঁড়াবার যে-বেদনা রক্ত
৬।
• মৃগয়ার যুদ্ধের ঘোড়া (নাসিমা সুলতানার কাব্য)
• কবিতা যাপনঃ মোস্তাক আহম্মদ দীন
• পৃথিবীর শেষ গ্রামঃ পলাশ দত্ত
বইটি আধুনিক কবিতার একাকীত্ব আর বিষাদলগ্নতা, কবি ও কবিতা বলা যায়, কবিতাই বইটির আরাধ্য। করি গুরু রবীন্দেনাথকেও এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় আলোচনা করা হয়েছে তার সৃষ্টি দর্শনের আলোকে। লেখ্কের ভুমিকা আমার খুব পছন্দ হয়েছে-
ঋতুকামিনীর রূপ ঝরে পড়ে মানে বুদ্ধিমান মানুষেরও রূপ ঝরে পড়ে। আর এই রূপ ঝরিয়ে দেওয়ার অনুঘটক যদি হয় মানুষ অথবা মানুষের জীবন পালনের মাতলামো, তাহলে কবিতা লেখেন যে ব্যক্তি, যাকে আমরা কবি বলে ডাকি, তিনি তার কবিতায় আঁকবেন সেই নদী বা রমনী বা ঘটনার ছবি, যে ছবিগুলোর ওপর জমেছে ধূলি-ধোয়া-রক্ত... ফলে প্রাচীন ভেনাসোপম কবিতার পাশে অর্বাচীন কবিতাগুলোকে মনে হবে ডাইনি বা যুদ্ধের বা জেনোসাইডের ছবি। জয়নুল আবেদীন যেমন দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকেন অথবা পিকাসো যেমন গোয়ার্নিকা তেমনি কবিও রচনা করেন রক্তের দাগ, ফলে কবিতা আপত হারিয়ে ফেলে তার কোমলতা অথবা বলা যায় যায় কবিতার যে সউন্দর্যটি পুস্পিত হয় তার জননীর নাম আর প্রেম থাকে না, হয়ে যায় বিষাদ যে কারনে বোদলেয়ার লিখেন “জীবন এক হাসপাতাল”, এলিয়ট লিখেন “লোকান্তরিত সব রূপসী নারী”।
শুরুতেই বলে রাখি, বইটি একটু কঠিন এই অর্থে যে, শব্দের উপর যথেষ্ট মাত্রায় দখল না থাকলে, প্রথমেই হোচট খেতে হবে, অর্থ উদ্ধারে কষ্ট করতে হবে বেশ, মস্তিস্ক কঠিন কঠিন শব্দের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইবে না, বেশ সময় নিয়ে বার বার পড়তে হবে। আমরা যারা সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করিনি কিংবা দীর্ঘদিন থেকে সাহিত্যচর্চায় থাকিনি তাদের জন্য একটি জটিল হবে পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে। তবে, কয়েকবার পড়ার পর, কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ পড়ার রসানুভুতি তৈরি হবে।
একটি ক্ষয়িষ্ণু মানুষের জীবনক্লান্তি, নির্বেদ, একাকীত্ব, রুগ্নতা,অসহায় আত্মঘাতী অস্তিত্বের চিত্রলেখই হচ্ছে আধুনিক সাহিত্য বিশেষ করে আধুনিক কবিতার অন্তরতম উপলদ্ধি। মানুষ দৈব্যের হাতে ক্রিড়ানক নয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা-রেনেসাসের এই উপলদ্ধিকে ব্যর্থ করে দিয়ে একশো বছরের মধ্যেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরি হলো ব্যক্তসর্বস্বতায়, একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতায় পতিত হলো সে। ফলে অনিবার্য হয়ে উঠলো বিচ্ছিন্নতা। কবিতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক বিশ্লেষনে আধুনিক কবিতা উঠে এসেছে প্রবন্ধে, রেফারেন্স দিয়েছেন শার্ল বোদলেয়ার থেকে শুরু করে এলিয়ট, জীবনানন্দ দাসের কবিতা। একাকীত্বের তীব্র যন্ত্রনা ভোগের অভিজ্ঞতা কিভাবে মানুষ পৃথিবীর কোন দেশকে নিজের ভাবতে পারে না, কোন দেশকে ভাবতে পারে না বাসযোগ্য হিসেবে। সুখী হওয়ার জন্য তাই সে পছন্দ করে এমন একটি স্থান যা পৃথিবীর বাইরে যা কেবন মৃত্যুর মাধ্যমেই সম্ভব, তাহলে কি মানুষ কামনা করছে সেই অনিবার্য মৃত্যুকেই?
পুরো গন্থ জুড়েই, অসাধারন সব বিশ্লেষন, কবিতার বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপট, একজন কবির অনুভব এবং মাত্রা ইত্যাদি। তৃতীয় ধাপে, কবিতার সাথে পাঠকের সম্পর্ক কেমন হবে? একজন পাঠকের কাছে সবচেয়ে বিপদজ্জনক মনে হয় “কবিতার মেটাফোর” এর ব্যবহার। পাঠক মূলত দৃশ্যমান কবিতার দেহটিকে বুঝতে চায়, দেহ থেকেই বুঝতে চেষ্টা করে কবিতার মানে বা বলার কথাটি কিন্তু রূপকের গোলকধাধায় পড়ে অনেক সময়য়ই খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে কবি, কবিতা এবং পাঠকের মধ্যে তৈরি হয় ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব। কবি বলেন-আমার কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে আবার পাঠক বলেন-কবিতার ছদ্মবেশে এক অহেতুক রচনা, সময়ের অপচয় মাত্র। একজন মানবীর চেয়ে রহস্যময় বা জটিল নয় কবিতা। মানবীকে না বুঝেই আমরা ভালোবাসি কিন্তু কবিতাকে বুঝতে চাই,বুঝতে চেয়েও বুঝি না। ভালোবাসা যদি পৃথিবী উদ্ধা্রের একমাত্র পথ হয় তবে মাবন হৃদয়ে সেই ভালোবাসাকে জন্মানোর একমাত্র বস্তুটি কবিতা।মূলত এটি একটি চলমান বিতর্ক এবং দ্বন্দ্ব।
কেউ কেউ ঈশ্বরের অদৃশ্য অস্তিত্বে বিশ্বাসী থাকেন, সেখানেই জীবনের মুক্তি খুঁজে পান আবার কেউ বা কবিতার রহস্যে মুক্তির সন্ধান খোজেন, তখন একজন কবি হয়ে ওঠেন অদৃশ্যের পুরোহিত। গ্রন্থের শেষে বেশ কয়েকটি কবিতা কাটাছেড়া করেছেন, বিশ্লেষন করেছেন যেমন পৃথিবীর শেষ গ্রাম, পুনশ্চ) আবার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ নিয়েও আলোচনা করেছেন-যেমন কবিতাযাপন, মৃগয়ার যুদ্ধের ঘোড়া ইত্যাদি।
সবমিলিয়ে কবিতা বিষয়ক কাব্যগ্রন্থটি একবার পড়ে, বুক শেলফে সাজিয়ে রাখার মতো কোন বই নয়, বরং হাতের কাছে, নিজের পড়ার টেবিলে রাখাটাই যৌক্তিক। বিচ্ছিন্নভাবে, একটু সময় পেলে এক পৃষ্ঠা পড়া কিংবা ঘুমানোর আগে যেমন ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ে, এটি তেমন বইও নয়। বেশ সময় নিয়ে বারবার পড়ার দাবী জানায় এই বইটি।
যারা বুক রিভিউটি পড়লেন, সবাইকে শুভেচ্ছা