পেছনের কথাঃ সম্প্রতি বাংলা কবিতার আসর-পশ্চিমবঙ্গ এর আয়োজনে সফলভাবে সমাপ্তি হলো, বাংলা কবিতা উৎসব-২০২২, বাংলাদেশ থেকে আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম। ফেরার পথে একদিন কোলকাতায় অবস্থান এবং কলেজ স্ট্রিটে (বই পাড়া নামে খ্যাত) ঘোরাফেরা। প্রিয় কবি বিভূতি দাস এর পরামর্শে সারাদিন কাটানো এবং বেশ কিছু দুর্লভ বই কেনা হয়েছিল। সেখান থেকে একটি বই এরই মধ্যে পড়া হয়ে গেলো এবং তার রিভিউ লিখছি। বলে রাখা ভালো, কলেজ স্ট্রিট সম্পর্কে এর আগে আসরের পাতায় কবি প্রবীর চ্যাটার্জি’র(ভোরের পাখি) একটি লেখা পড়েছিলাম, “আউট অফ প্রিন্ট বই চান ? আসুন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ায়”। সে কারনেই কলেজ স্ট্রিট এবং বই পাড়া সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
একালের কবিতা-পাঠকের দর্পনেঃ
বইটি লিখেছিন, তরুণ মুখোপাধ্যায়, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । প্রকাশক- কেশব আড়ু, সোনার তরী, ৪এ নর্থ নওদাপাড়া রোড, কোলকাতা-৫৭। বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে কিন্তু এরই মধ্যে তৃতীয় প্রকাশনাও হয়েছে ২০০৯ সালে। কবিতার পাঠক পরিসংখ্যাংনগতভাবে এমনিতেই কম থাকে, তাও আবার কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ এবং তার তৃতীয় প্রকাশনা!! প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিলাম। কিন্তু বইটি পড়ার পর ধারনা পালটে গেলো, আসলেই বইটি অসাধারন বিশেষ করে যারা কবিতা লিখেন এবং কবিতার উপর আলোচনা লিখে থাকেন। কবিতার আসরে আমি নিয়মিতই কবিতার উপর আলোচনা লিখে থাকি (এখন পর্যন্ত ২১৫টি লিখেছি)। বইটি পড়ার পর মনে হলো আমার আলোচনার ম্যাচুরিটি এখনো কিছুই হয়নি। ফলে নিঃসন্দেহে বইটি আমার লেখার মানের উতকর্ষতা তৈরিতে যথেষ্ট ভুমিকা রাখবে।
বইয়ের প্রথম অংশ-কবিতা পাঠের ভুমিকাতে আছে ৭টি প্রবন্ধ-
১। কবিতা-শেষ কথা কে বলবে
২। কবিতার সেকাল-একাল
৩। আধুনিক কবিতা-সংজ্ঞা ও পটভুমি এবং
৪। কবিতায় শিল্প-ভাষা-চিত্রকল্প-ছন্দ
৫। কবি ও পাঠক-স্থির বিষয়ের দিকে
৬। কবিতা ও প্রেরণা
৭। আধুনিক কবিতা ও কমিউনিকেশন
বইয়ের দ্বিতীয় অংশ- কবিতা পাঠকের দর্পণে, আছে ২৬জন বিখ্যাত কবি’র ৫২টি কবিতা নিয়ে আলোচনা-
১। জীবনান্দ দাস
২। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৩। অমিয় চক্রবর্তী
৪। প্রেমেন্দ্র মিত্র
৫। অজিত দত্ত
৬। বুদ্ধদেব বসু
৭। বিষ্ণু দে
৮। অরুণ মিত্র
৯। সমর সেন
১০। সুভাষ মুখোপাধ্যায়
১১। বীরেন্দ্র চট্রোপাধ্যায়
১২। রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী
১৩। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৪। রাম বসু
১৫। সুকান্ত ভট্রাচার্য
১৬। শঙ্খ ঘোষ
১৭। তরুণ স্যানাল
১৮। শক্তি চট্রোপাধ্যায়
১৯। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২০। দীনেশ দাস
২১। শামসুর রহমান
২২। ভাস্কর চক্রবর্তী
২৩। দাবারতি মিত্র
২৪। জয় গোস্বামী
২৫।অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত এবং
২৬। অমিতাভ দাসগুপ্ত
লেখক ভুমিকাতে লিখেছেন যা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, “কবিতায় দশক বিভাগ প্রচলিত, যদিও তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের ও সংশয়ের সীমা নেই। সেই বিতর্ক থেকে আমি সরে যেতে চাই। শুধু বলা যায়, দশকের বিন্যাসে, রবীন্দ্রোত্তর কবিকুলের কাব্যরচনার পর্ব-পর্বান্তর চেনা সহজ হয়ে পড়ে। আমি মানি, কোন দশকের বৃত্তে কোন কবি আবদ্ধ নন। একেক দশকে একেক কবি’র বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা ঘটে গেল, এমন সংস্কারও আমার নেই। তিরিশ দশকের বহু কবির দীপ্তি চল্লিশ দশকে, চল্লিশ দশকের বহু কবির খ্যাতি পঞ্চাশ দশকে বিকীর্ণ হয়েছে। সেটা বড়ো কথা নয়। আমি শুধু সূচনাপর্ব রূপে বিভিন্ন দশকের কবিদের বেছে নিতে চাই”।
লেখক নানা জনের দৃষিভঙ্গির ব্যাখাসহ নিজের একটা বিশ্লেষন দাড় করিয়েছেন দুটো মৌলিক প্রশ্নকে সামনে রেখে যা কবিতা সম্পর্কে সাধারণ্যে সর্বদা তর্জনী উচিয়ে থাকে- কবিতা কি? কী তার কাজ? এবং কবিতা লেখা হয় কিভাবে? কবিতাকে মূলত দুটো স্থুল ভাবে দেখা যেতে পারে-
1. the poetry of real life
2. the poetry of a land of fancy
কবিতা সম্পর্কে বেশ জোড়ালো একটা বিশ্লেষন বইয়ের শুরুতেই দিয়েছেন- কল্পনা ছাড়া কি কবিতার জন্ম অসম্ভব? একজন কবি কি কল্পনা প্রতিভাধর? কবিতা সৃষ্টির ভিতরে কি অলৌকিকতা থাকে? ইত্যাদি নানা প্রশ্নের ব্যাখা বিশ্লেষন, বিখ্যাত সব কবি এবং লেখকের উক্তি তুলে ধরেছেন যা চিন্তার জগতকে নুতন চিন্তার দিকে নিয়ে যায় অবলীলায়।
যে কোন কবিতা পাঠ করতে গেলেই পাঠক প্রথমে তার দৃশ্যরূপ দেখে তারপর তার শব্দ ও ছন্দঝংকারে কানকে তৃপ্ত করে, সবশেষে আসে অনুভব। এই অনুভব সৃষ্টির দায় কি কেবল একজন কবি’র ওপর বর্তায় নাকি পাঠককেও এগিয়ে আসতে হবে। এরকম নানা অমীমাংসিত প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা নিয়ে আলোচনা করেছেন বইয়ের শুরুর প্রবন্ধগুলোতে। মূলত কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলো নুতনদের ভাবনাকে শানিত করার জন্য বেশ কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে বলেই আমার মনে হয়েছে। অন্তুত আমি তো প্রবন্ধগুলো বারবার পড়বো যতোক্ষন পর্যন্ত না তা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারবো এবং নিজের মতো করে প্রশ্নগুলোর ব্যাখা দাড় করাতে পারবো।
আধুনিক কবিতা ও কমিউনিকেশন নিয়ে প্রবন্ধটি বেশ মজার এবং ভাবনা উদ্রেকারী। জীবনান্দের গভীর উপলব্ধির নির্যাসকে বদলে দিয়ে যারা বলেন- সকলেই পাঠক নন, কেউ কেউ পাঠক-তারা খানিকটা সরলীকরন করে ফেলেন। অনেক নিবিড় পাঠকও কমিউনিকেশন গ্যাপের শিকার হন।
কবিতা আলোচনা অংশে, যে ২৬জন বিখ্যাত কবি’র ৫২টি কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। একটা কবিতা কতোভাবে পাঠকে আলোড়িত করে, কতোভাবে কবি তার ভাবনাগুলোকে ছড়িয়ে দেয়, কতো রকমভাবেই না, উপমাগুলো যথার্থভাবে ব্যবহার হয়!! কবি তার কবিতার মাধ্যমে পাঠকের সাথে একটা নিবিড় যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করে, আলোচনা গুলো পড়লে কবিতার গভীরে পোঁছানো যায় খুব সহজে। কবিতা লেখাঁ এবং কবিতা পাঠ করা দুটো ভিন্ন মাত্রার দক্ষতা। কবিতা যেমন গায়ের জোরে লেখা যায় না, কবিতা হয়ে ওঠে। তেমনি কবিতার পাঠক রাতারাতি তৈরি হবে না, কবিতা পাঠকে আলোড়িত করতে হবে তবেই নুতন নুতন পাঠক তৈরি হবে কিন্তু তাই বলে পাঠক চাহিদা নির্ভর কবি তার কবিতা লিখবেন না, সেটা কখনোই কাম্য নয়।
বইটি পড়ে, কবিতা আলোচনার কাঠামো, কবিতার বিশ্লেষনের নানা দিক, কবিতার গভীরতা উদঘাটন ইত্যাদি নানা বিষয়ে শেখা হয়েছে। এরকম আরো বইয়ের খুব অভাব অনুভব করলাম। বইটি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের প্রতিও আরো বেশী আসক্তি তৈরি করলো আমার।