[আলোচনার পাতায় এরকম শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো একটু থমকে গিয়ে, তিরস্কারের প্রস্তুতি নিতে পারেন। শুরুতেই বলে রাখি, ভিন্ন জনের ভিন্ন মতামত থাকতেই পারে। আমার সাথে আপনি/আপনারা অনেকেই একমত পোষণ নাও করতে পারেন। অন্যজনের মতামত গ্রহন করা না যেতেই পারে কিন্তু তার মতামতকে শ্রদ্ধা জানানোই কবিদের উত্তম প্রতিশ্রুতি]
একটা প্রচলিত রেওয়াজ আছে, সাধারনত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে সাহিত্য কিংবা কবিতার আসরে, কবি সাহিত্যিকদে্র সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ক্রেষ্ট, উত্তরীয়, স্মারক ইত্যাদি প্রদান করা হয়ে থাকে। বাংলা কবিতা ডট কম আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতেও সেই রেওয়াজ ধরে রাখা হয় যা খুবই প্রয়োজনীয় এবং গ্রহনযোগ্য বলেই আমার মনে হয়। কেউ যখন কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে, কেবল তখনই তিনি সেটা পাবার যোগ্যতা অর্জন করেন অর্থাৎ আয়োজকগন তাকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ক্রেষ্ট/উত্তরীয়/সন্মাননা স্মারক ইত্যাদি উপহার দিয়ে থাকেন। কিন্তু যিনি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করবেন না কিংবা করতে পারবেন না, তাকে কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়? এটা হতে পারে?
যে কেউ, যে কোন কারনে উপস্থিত নাও থাকতে পারেন (যেমন-ভিসা সমস্যা, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন যৌক্তিক কারন), কারন যাই হউক, কেউ যখন কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন না, তখন তাকে আমরা লিখিতভাবে (ইমেইল অন্য অন্য কোন ভার্সনে) সম্মান প্রদর্শন করতেই পারি কিন্তু ক্রেষ্ট জাতীয় উপহার কেন প্রদান করবো, তার যৌক্তিকতা কি? যৌক্তিক কারন খুজতে গিয়েই “বাণিজ্য” শব্দটির ব্যবহার হলো এখানে।
ধরা যাক,আমি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করেছি, তালিকায় আমার নাম রেখেছি কিন্তু প্রাসঙ্গিক কারনেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি, ফলে আমার নামে তৈরিকৃত ক্রেষ্ট আয়োজকগন সৌজন্যতাবশত অন্য কারো মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অন্যজন, যার অনুষ্ঠানে যাবার ইচ্ছেই হয়তো ছিল না, কিন্তু রেজিষ্ট্রেশন করেছেন, তার নামেও তৈরীকৃত ক্রেষ্ট একইভাবে অন্য কারো মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ৩য় জন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাকে ক্রেষ্ট প্রদান করা হলো। তিনজন ব্যক্তিকে একইভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হলো?
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আয়োজকগন একটা অনুষ্ঠান সার্থক করতে তোলেন ফলে অন্যদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করা নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পরে। ফলে, যিনি কথা দিয়েছিলেন উপস্থিত থাকবেন কিন্তু যে কোন কারনেই হউক উপস্থিত থাকতে পারলেন না, তার পরবর্তী দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, আয়োজকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা এবং যথার্থ কারন উল্লেখ করা। অথচ ঘটনা হচ্ছে উলটো- আয়োজকগন আবার তার নামে তৈরিকৃত ক্রেষ্ট তার বাসায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছেন, খুবই হাস্যকর ব্যপার !!!
শুধুমাত্র যিনি, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে, অনুষ্ঠানকে সবার্থক করে তুলছেন, কেবল মাত্র তিনিই ক্রেষ্ট জাতীয় উপহার আয়োজকদের পক্ষ থেকে পাবার যোগ্যতা রাখেন, তখন তিনি সেই সম্মানটা অর্জন করেন, উপস্থিত না থেকে সেই সম্মান অর্জন হয় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে তৈরীকৃত ক্রেষ্ট, উত্তরীয় এর কি হবে? তার জন্য তো অর্থ খরচ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমার স্পষ্ট এবং যৌক্তিক অবস্থান, সেগুলো ফেলা দেয়া হবে, কিছু অর্থে অপচয় হয়তো হবে কিন্তু অনুপস্থিত ব্যক্তির বাসায় পৌঁছে দেয়া “ক্রেষ্ট বাণিজ্য”কেই প্রমোট করা হয়।
ধরা যাক, আমি একা/একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলাম না এবং যথারীতি আমার বাসায় এক/একাধিক ক্রেষ্ট এলো এবং শোভা বর্ধন করলো। আমার সামাজিক মর্যদা বৃদ্ধি পেলো, অন্যরা আমার ক্রেষ্ট দেখে তারিফ করবে, আমি এক মহান কবি, এতো এতো অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রন পেয়েছি, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি, আহা !! রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবার বাসনাও পূর্ণ হয়ে গেলো আমার!!! কেউ তো আর জানলো না যে, আমি কোন অনুষ্ঠানেই উপস্থিত থাকিনি!! তাহলে আর এতো ঝামেলা করার দরকার কি? অল্প কিছু টাকা খরচ করে দোকান থেকে একবারে ২০/৩০টা ক্রেষ্ট তৈরি করে নিলেই হয়, শুধু ২০২০, ২০২১, ২০২২, ২০২৩ এরকম সাল বসিয়ে দিলেই হয়। ফলে, ধীরে ধীরে এভাবে “ক্রেষ্ট বাণিজ্য”কে প্রমোট করা হয় এবং এ কারনেই ইদানিং আর ক্রেষ্ট প্রাপ্তিকে কেউ সমীহ করে না। আমরা একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে, নিজেরাই হাস্যরসের পাত্র তৈরি করে ফেলি। ক্রেষ্ট প্রদানের মাধ্যমে অন্যকে সম্মান জানানো একটি উচ্চতর স্তরের প্রক্রিয়া কিন্তু আমরা নিজেরাই সেটার মান নীচু করে ফেলছি শুধুমাত্র “ক্রেষ্ট প্রদান না করলে উনি কি মনে করবেন” কিংবা “ওনার নামে ক্রেষ্ট ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে”, এ সমস্ত সস্তা ইমোশনের কারনে।
আমার নিজের কাছে পুরো বিষয়টা পরিস্কার না, আয়োজকগন কেনই বা অনুপস্থিত ব্যাক্তিকে ক্রেষ্ট প্রদান করবেন?? এবং অনুপস্থিত ব্যক্তিই বা কেন সেই ক্রেষ্ট গ্রহন করবেন?? পুরো প্রক্রিয়াটাই একটা সম্মান জনক অবস্থান কিন্তু আমরা এখন যা করছি, সেটা কি যথার্থ সন্মানপ্রদান করা হচ্ছে??
আমার জানা মনে, কবি’দের আত্ম সম্মানবোধ থাকে খুব টনটনে, তারা তাদের জীবন চর্চায় সেই বোধটা ধরে রাখার আপ্রান চেষ্টা করেন সারা জীবন ধরে। তাদের অভ্যাসে, আচার আচরণে, চিন্তা, চেতনায়, কথায়, এবং জীবন দর্শনে সেই আত্মসম্মান বোধ বজায় রাখার চেষ্টা করেন সব সময়।
কাথি (২০২২) এবং ত্রিপুরা (২০২৩) দুটো অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমার মতামত শেয়ার করলাম সবার সাথে, অন্যরা আমার সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। ভিন্ন কোন যুক্তি শোনার অপেক্ষায় রইলাম।