বাংলা কবিতার আসরে প্রতিদিন শতাধিক কবিতা প্রকাশ হয়, কিন্তু মন্তব্য, প্রতি-মন্তব্য প্রকাশ হয় এবং আলোচনার পাতায় অল্প কিছু আলোচনাও প্রকাশ হয়। এসব কর্মযজ্ঞকে কেদ্র করে মাঝে মাঝেই আলোচনার ঝড় ওঠে আবার থেমেও যায় সময়ের আবর্তে কিন্তু কোন উত্তোরন হয় না। আবার কিছুদিন পর একই ধরনের সমালোচনা, মন্তব্য পালটা মন্তব্য চলতে থাকে অনেকটা জাবর কাটার মতো। সমালোচিত ইস্যুগুলো কি?
১। কবিতার গুনগত মান দিন দিন কমে যাচ্ছে
২। কবিতা চর্চায় গুনগত মান অপেক্ষা পরিমানগত/সংখ্যা গত বৃদ্ধিই হচ্ছে
৩। কবিতায় মন্তব্য অনেকটা “পিঠ চুলকে” দেয়ার আচরন দেখা যায়
৪। মন্তব্যগুলো গতানুগতিক, কপি-পেষ্ট, নিজের কবিতায় মন্তব্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়া এবং অন্যের মন রক্ষা করার প্রয়াস।
৫। আলোচনার পাতায় লেখক কম, পাঠকের সংখ্যা আরো কম ইত্যাদি
১নং, ২নং এবং ৫নং বিষয়গুলো নিয়মিত চর্চা এবং আগ্রহের সাথে সম্পর্কিত। কাউকে জোর করে তার চর্চা বাড়ানো যায় না। নিজের ইচ্ছায়, নিজের সচেতনতায় কেউ তার উত্তোরন না ঘটালে সমালোচনার মাধ্যমে এর সমাধান হবে না, হওয়ার কোন সুযোগ নেই, সম্ভাবনাও নেই। ইস্যুটি একেবারেই ব্যক্তি পর্যায়ের ইস্যু।
৩নং এবং ৪নং ইস্যু ব্যক্তির নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত এবং এর উত্তোরন যতোটা না সমালোচনার মাধ্যমে সম্ভব তার চেয়েও বেশি জরুরী ব্যক্তির নৈতিকতা উত্তরনে নিজের সচেতন প্রয়াস। কবি, কবিতা চর্চা এবং নৈতিকতা চর্চা হিসেব অনুযায়ী একই সুত্রে গাথা থাকার কথা কিন্তু থাকছে না তো। আমরা নিজেরাই নৈতিকতার অবক্ষয়ের সমালোচনা করি আবার নিজেরাই সেই একই কাজ করি। যে অনৈতিক কাজ আমি নিজেই করি, সেটা অন্যের থেকে না করার প্রত্যাশা কেন করি?
মানুষের নৈতিকতা যখন সে নিজেই পরিবর্তন না করে, উত্তোরন না ঘটায় তখন অন্যেরা বাইরে থেকে প্রযুক্তির সহায়তায় কিন্তুটা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটা করাও কি নৈতিকতার মধ্যে পরে কিনা? আমার মতামত, হ্যা পরে, যদি সেটা বৃহত্তর প্রয়োজনে হয়। কিন্তু কোন ক্ষুদ্র সার্থে অন্যের মতামত বা ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপও এক ধরনের অনৈতিক চর্চা।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি উদাহরন দিই-
১। আমি একবার কানাড়া গিয়েছিলাম পড়াশুনার জন্য। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর থেকে শুরু করে সবার মধ্যে “পরিবেশ সচেতনতা” দেখেছি বেশ উঁচু পর্যায়ের। অহেতুক ফটোকপি/প্রিন্ট করা থেকে সবাইকে বিরত রেখে নির্বিচারে গাছ কাটা নিয়ন্ত্রন করা একটি আন্দোলন। আমাদের সবার একটি একাউন্ট ছিলো, সেখানে আগেই ডলার জমা রাখতে হতো ফটোকপি/প্রিন্ট বাবদ (সেটা অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব ছাত্র ছাত্রীকেই ফটোকপি বাবদ, মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান ডলার প্রত্যেকের একাউন্টে জমা রাখতো)। প্রতি পৃষ্ঠা ফটোকপি/প্রিন্টের জন্য ডলার/পেনি কাটা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ডলার শেষ হয়ে গেলে নিজের পকেট থেকে রিফিল করতে হতো। একাউন্টে ডলার না থাকলে, প্রিন্ট/ ফটোকপি হবে না। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি পয়েন্ট থেকে (কম্পিউটার ল্যাব) ফটোকপি/প্রিন্ট করা যেতো এবং সবগুলো পয়েন্টের সাথে প্রত্যেকের একাউন্ট লিঙ্ক করা ছিলো। প্রযুক্তির সহায়তায় এভাবে অনৈতিকতা চর্চা/ অসচেতনতাকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।
২। বাংলাদেশে আমি যখন ইউনিসেফ এ কাজ করতাম। সেখানে দেখেছি অহেতুক কাগজ, কালি নিয়ন্ত্রন করার জন্য, ফটোকপি এবং প্রিন্টার এর উপর নিয়ন্ত্রন করা হতো। একইভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, মাস শেষে দেখা যেতো কার কম্পিউটার থেকে কতো বেশি প্রিন্ট/ফটোকপি হয়েছে এবং সেটাকে ভাবা হতো তার অদক্ষতা, তার বেহিসেবী আচরনের বহিঃপ্রকাশ।
এরকম আরো অনেক উদাহরন আছে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। তাছাড়া আমি যেহেতু মানুষের আচরন পরিবর্তন নিয়ে কাজ করি (SBCC-Social Behavioral Change Communication), সে কারনে অনেক ধরনের পদ্ধতি, কৌশলের সাথে আমি পরিচিত।
একটি কাল্পনিক চিত্রঃ
উপরে উল্লেখিত, ৩নং এবং ৪নং সমালোচিত ইস্যু নিয়ে একটি কাল্পনিক চিত্র এমন হতে পারে-
বাংলা কবিতার আসরের প্রত্যেক সদস্যের বিকাশ একাউন্টের মতো একটা একাউন্ট থাকবে, সেখানে একটা এমাউন্ট সদস্য ফি হিসেবে প্রথমেই জমা থাকবে। কেউ সেই টাকা উত্তোলন করতে পারবে না। কেবল মাত্র সদস্য পদ কোন কারনে বাতিল হলে কিংবা সেচ্ছায় সদস্য পদ বাতিল করলে সে নিজে টাকা উত্তোলন করতে পারবে।
•প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ভালো কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য দেয়া থাকবে। প্রতিদিন একটি ভালো কবিতা পোষ্ট হলে তার একাউন্টে ১০০ টাকা জমা হবে। মানোত্তীর্ন নয় এমন কবিতা পোষ্ট করলে ১০০ টাকা কাটা হবে তার একাউন্ট থেকে। তাহলে দিনে কয়টি কবিতা পোষ্ট হবে??? কবিতা পোষ্ট দেয়ার আগে কতোটা আত্মবিশ্বাসী হতে হবে? কবিতা লেখা এবং পোষ্ট দেয়ার ক্ষেত্রে কতোটা সচেতন হতে হবে???
•একই মন্তব্য পোষ্ট হলে, টাকা কাটা যাবে। দিনের সর্বোচ্চ ১০টি ভালো মন্তব্যের জন্য তাদের একাউন্টে টাকা জমা হবে। তাহলেও কি “পিঠ চুলকে দেয়ার” চর্চা অব্যহত থাকবে???
এভাবে অনেক কিছুই হতে পারে।
এইটুকু পড়ার পর অনেকেরই হয়তো হাত নিশপিশ করছে, এই লেখার কড়া একটি সমালোচনা লেখার জন্য। হয়তো ভাবছেন-
•কবিতা, কবিতা চর্চাকে এভাবে প্রযুক্তির সাথে মিশিয়ে যান্ত্রিকতার রূপ দেয়া মোটেই ভালো লক্ষন নয়।
•কাব্য চর্চাকে কর্পোরেট চর্চায় নিয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি। কবিদের অবাধ স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ
•গুনগত মান নিয়ন্ত্রন করার নামে, কাব্য চর্চাকে কখনো নিয়ন্ত্রন করা উচিত না।
•নৈতিকতা এবং কাব্য চর্চা দুটো ভিন্ন বিষয়, দুটোকে এক সূত্রে গাথার কোন সুযোগ নেই।
তাহলে, পরের প্রশ্ন আসে-
•কাব্য চর্চাকে আমরা কিভাবে দেখবো? নৈতিকতা চর্চার বাইরের কিছু?
•একজন কবি’র জীবনাচরন, তার জীবন যাপন, ধরন ইত্যাদি ছবি আমরা কিভাবে দেখি/মনে আঁকি?
উপরের দুটো প্রশ্ন নিয়ে পরের লেখা…