আলোচনা  ২৩৩

মানবিক এক দহন থেকেই কবিতাটি লিখা হয়েছে, তা স্পস্টত বোঝা যাচ্ছে। কবি মোঃ রাশেদুল ইসলাম, এর কবিতা, “নীরব প্রস্থান”। প্রতিবছর, আমরা এমন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে থাকি, ডিসেম্বর ৩১, তারিখে, নুতন বছরকে উদযাপন উপলক্ষে।

ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি দেশ নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী নুতন বছরকে স্বাগত জানায়, ২০২৫ সালকেও স্বাগত জানিয়েছে, বর্ণিল আতশবাজি, আলোকসজ্জা এবং সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে, নতুন বছরের আগমনে মেতে উঠেছে সারা বিশ্ব।  ২০২৫, ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন বিশ্বে প্রথম শুরু হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্র কিরিবাতি এবং টোঙ্গায়। এখানকার সময় অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা (গ্রিনউইচ মান সময়) থেকে নতুন বছর শুরু হয়েছে।

এছাড়া বিশ্বে সবার আগে নতুন সালকে স্বাগত জানানো দেশের তালিকায় রয়েছে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। অকল্যান্ডের স্কাই টাওয়ার এবং সিডনি হারবার ব্রিজের আতশবাজি দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ তৈরি করেছে, যা স্থানীয় ও পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ ছড়িয়েছে। ইউরোপে নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল আলোকসজ্জা আর আতশবাজি। লন্ডনের বিগ বেন ও থেমস নদীর তীরে জমকালো আতশবাজি হাজারো মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের আলোকিত সৌন্দর্য এবং রোমের ঐতিহাসিক স্থানে উৎসবের আমেজ সবাইকে আনন্দে ভাসিয়েছে। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বিখ্যাত বল ড্রপ ইভেন্ট বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। হাজারো মানুষ একত্রিত হয়ে নতুন বছরের কাউন্টডাউন উদযাপন করেছে। পাশাপাশি, কনসার্ট, প্যারেড এবং পারিবারিক আয়োজনে দেশব্যাপী নববর্ষের উৎসব চলেছে।

এশিয়ার দেশগুলোতে নববর্ষ উদযাপন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। জাপানে মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি দিয়ে নতুন বছর শুরু হয়েছে, আর চীনে পরিবারসহ সময় কাটানোর রীতি প্রচলিত। ভারত ও বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রঙিন উৎসব নতুন বছরকে উজ্জ্বল করে তোলে সব সময়ই। সেই সাথে রাতের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল, আতশবাজি আর পটকার বিকট শব্দে।

সবই ঠিক আছে, মানুষ আনন্দ উৎসব করবে, নানা আয়োজনে নুতন বর্ষকে স্বাগত জানাবে…

কিন্তু এই গ্রহ, এই বিশ্ব কি শুধুই মানুষের জন্য? এই প্রশ্নটিই কবিতার মূল বক্তব্য।

যখন আমরা বলি, পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি, এখানে “আমরা” শব্দটি উচ্চারন করি, এর অর্থ কি? আমরা মানে কি শুধুই মানুষ? অন্যান্য প্রানীও “আমারা’র মধ্যে থাকে, গাছ পালাও “আমারা’র মধ্যে থাকে, নদী নালা, পর্বত সবই “আমারা” শব্দের মধ্যে নিহিত। তাহলে, আমরা কি শুধুই আমাদের জন্য উৎসবের আয়োজন করেই ক্ষান্ত হবো? এই যে,”আমরা” শব্দের মধ্যে আরো অনেকেই আছে, তাদের কথা কি ভাববো?

আমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, অন্যান্য প্রানীদেরও অধিকার রয়েছে নিরাপদ থাকা, বিকট শব্দহীন থাকা, গাছেদেরও অধিকার রয়েছে, মুক্ত বাতাসে থাকা, নদীরও অধিকার রয়েছে, সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে। এই যে সবার অধিকার রয়েছে, সেটা কি হরণ করা হচ্ছে, শুধুমাত্র মানুষের আনন্দের জন্য, মানুষের উৎসবের জন্য? প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী, খাদ্য শৃখলার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, একে অপরের উপর নির্ভরশীল আমরা সবাই, একজনকে ভক্ষন করেই অন্যরা বেঁচে থাকে, টিকে থাকে। কিন্তু সেটা তো দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যেমে হতে হবে।

আজ সে আকাশে আতশবাজির আগুন,
আর পটকার দহন—
যেখানে ঝরে পড়ে অসংখ্য প্রাণ।

কবি , সে কথাই বলতে চেয়েছেন, নুতন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে যে ধরনের আচরণ আমরা করে থাকি, সেখানে অসংখ্য প্রাণের সংহার হয়, অনেক প্রানের মৃত্যু ঘটে। তাহলে আর আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করি কেন? মানবিক দারী করি কেন?

পাখিদের সেই কান্নার শব্দ,
আমাদের উৎসবের মাঝেই লুকিয়ে থাকে,
তাদের বিদায় গান কে শোনে?
তাদের শেষ উড়ানের গল্প কে বলে?

পাখিদের কান্না কি আমরা শুনতে পাই? শুনতে কি চাই? বিকট পটকা আর আতসবাজির আড়ালে, পাখিদের কান্না, গাছেদের কান্না হারিয়ে যায়। আমাদের আনন্দের উল্লাসের কারনে, প্রকৃতির বুকে গভীর ক্ষত তৈরি হয়, সেটা কি আমরা দেখতে পাই?

আপাদ দৃষ্টিতে বিষয়টি খুব হালকা মনে হতে পারে, আমাদের ভাবনার গভীরতা কতটূকু? যতোটা দাবী করি, তার কতটুকু প্রতিফলন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রকাশ করতে পারি? শুধু নববর্ষের কথা বাদ দিলেও, সারা বছর জুড়ে, হানাহানি, যুদ্ধ, অস্ত্রের ঝনঝনানীর মাধ্যমে আমরা এই গ্রহকে কতটুকু নিরাপদ রাখতে পারি, গ্রহের অন্য সবাইকে নিয়ে কি “আমরা” ভাবতে পারি?

একদিনের একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে, কবি রচনা করেছেন কবিতাটি, তার মানবিক বোধ জাগ্রত হয়েছে, দহনে কেটেছে মধ্যরাত থেকে ভোর অবধি, জানান দিয়েছেন, আমাদের সবার বিবেককে।

কবি’র জন্য রইলো অফুরন্ত শুভেচ্ছা