আলোচনা ১২৬
কেউ নাই, বলতে পারি না, ঠিকানা, নিন্দুকপাল এবং অতলে, আসরের পাতায় জানুয়ারী ২৫-২৯, ২০২২ তে প্রকাশিত কবি ফারহাত আহমেদ এর কবিতা আলোচনা করতে বসে, পর পর আরো বেশ কিছু কবিতা এক বসাতেই পড়লাম যদিও তার কবিতা নিয়মিতই পড়ি, তার দুটো বইও আমি গিফট পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে, সেগুলোও পড়া হয়েছে। তার লেখা এবং ভাবনাগুলো একটু ভিন্ন ধারার, সচরাচর যে ধরনের কবিতা পাতায় দেখি, তারচেয়ে ভিন্ন ধারার ভাবনা দ্বারা চালিত তিনি। তার কবিতা বরাবরই আকারে খুব ছোট মাপের কিন্ত প্রত্যেক কবিতাতেই কিছু না কিছু ম্যাসেজ থাকে। শুধু “কবিতা লেখার জন্যই কবিতা লেখা” এরকমটা তার ক্ষেত্রে ঘটে না। প্রত্যেকটা কবিতাতেই তিনি কিছু বলতে চান, কিন্তু ইঙ্গিত করতে চান। আমার কাছে বরাবরই তার কবিতা “রিয়ালিজম” এবং “অ্যাফোরিজম” এর সংমিশ্রন মনে হয়।
* রিয়ালিজম (বাস্তববাদ) এ মতানুসারে, সাহিত্যে ঘটবে বাস্তবের প্রতিফলন।।কাজেই ভাষা হবে সহজ সরল, সাধারন মানুষের মুখের কাছাকাছি। মূলত মানুষের বাস্তব জীবন নিয়ে, সমাজ ও জীবনযাপনের সমস্যা নিয়ে। কবি হবেন সোশ্যালি কমিটেড এবং তিনি বাস্তবতার ছবি আঁকতে পারবেন। এখানে সৌন্দর্যের সন্ধান চলে ভাষা অপেক্ষা বিষয়ের উপর বেশী। জর্জ ক্র্যাবল, রবার্ট ফ্রষ্ট্রের কবিতায় বহুল পরিমাণে বাস্তবের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।
**অ্যাফোরিজম একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য যা সত্যকে একটি স্মরণীয় উপায়ে প্রকাশ করে। সত্য বা মতামতকে মজাদার পদ্ধতিতে বর্ণনা করতে এটি সত্যের বিষয়টিকে নিয়োগ করে। নীতি, সাহিত্যিক এবং দার্শনিক নীতিগুলিতে প্রায়শই অ্যাফোরিজম প্রয়োগ হয়। যেহেতু এফোরিজমে সত্য থাকে তাই সেগুলি সর্বজনস্বীকৃত। আলেকজান্ডার পোপ ১৮ তম শতাব্দীতে এফোরিস্টের একজন দুর্দান্ত স্রষ্টা ছিলেন। অ্যাফোরিজমের উদাহরণ হতে পারে-
"যে ব্যক্তি পর্বত সরিয়ে দেয় সে ছোট ছোট পাথর কেড়ে নেয়া শুরু করে"
"কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ. জ্ঞান সীমাবদ্ধ। কল্পনা বিশ্বকে ঘিরে রেখেছে”
“কিছুই না থাকায়, সে কিছুই হারাতে পারে না।”
“কেউ নেই”, কবিতায় কবি ফারহাত আহমেদ বলেন- “কেউ নেই, কেউ থাকার কথা না”, বাস্তবতা হলো আসলে কারো থাকার কথা না” কিন্তু আমরা ভাবি, আমাদের চারপাশে সবাই আছে, দেখতে পাই অনেকেই আছে, আত্মীয় পরিজন, ভালোবাসার মানুষ, কিন্তু কারোর ভেতরটা দেখতে পাই না, প্রকৃত পক্ষে আছে কি না আমরা জানি না, কিন্তু নিজের ভেতরটা জানি, দেখতে পাই, তাই কবি আবার বলেন-“অন্তরে তুমি, তোমাকে লুকিয়ে এইভাবে আমি চলছি”, কেউ জানে না, আমরা অন্তরে কি ধারন করি, কাকে মনে রাখি। ভেতর এবং বাহির, দুটো আলাদা কিংবা এক, দুটোই এক চরম বাস্তবতা। ভেতর এবং বাহিরকে নিয়ে নানা দর্শন আছে, বাস্তবতার সাথে মিল-অমিল দুটোই আছে। কবি এখানে খুব অল্প পরিসরে, রিয়ালিজম এবং দর্শন এর মিশেল ঘটিয়েছেন।
“বলতে পারি না” কবিতায়, অ্যাফোরিজম এর এক দারুন উদাহরন দেখতে পাই, “বলতে পারি না, আমি যা জেনেছি”, আমরা অনেক কিছুই জানি, বুঝি, দেখি কিন্তু বলতে পারি না নানা কারনে, সমাজের নানা অসংগতি আমরা উপলব্ধি করি, আমরা প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ি কিন্তু বলতে পারি না। কবি আবার বলেন-“ রাজাকার ছিলো চক্ষের বিষ, দৌড়ের মাঝে রাখি, বলতে পারি না, এখন তাদের জ্বালায় দৌড়ে থাকি”, একটি সত্যকে কবি এভাবেই উপস্থাপন করেছেন অ্যাফোরিজম ধারার কবিতার মাধ্যমে।
“ঠিকানা” কবিতাকে দুভাবেই ভাবা যেতে পারে, প্রেম পর্বের কবিতা হিসেবে, “এক পাখি তবু ঠিকানা চাইলো খেয়ালে বা বেখেয়ালে”, আশার প্রদীপ জ্বলে উঠলো কিন্তু কিন্তু সে আসলো না, পরিস্কার করে কিছুই বললো না। আবার অন্যভাবে “অকৃতজ্ঞতার” নমুনা হিসেবেও ভাবতে পারি। মানুষের নানা উপকার করার পরও, মানুষ শেষ পর্যন্ত অকৃতজ্ঞই থেকে যায়, দুটো ভাবনাকেই “রিয়ালাজম” ধারায় ফেলতে পারি।
আবার “নিন্দুকপাল” কবিতায় ভিন্ন একটা রিয়ালিজম নিয়ে লিখেছেন। ছোটবেলায় “পাছে লোকে কিছু বলে” কবিতা আমরা সবাই পড়েছি, এটা নিয়ে পরীক্ষার খাতায় ভাবসম্প্রসারণও লিখেছি। এখানে একটি চরম বাস্তবতা, রিয়ালিজম নিয়েই কবির ভাবনা আবর্তিত হয়েছে। নিন্দুক আমাদের চারপাশেই থাকে, সার্বক্ষনিকভাবে আমাদের মনে সমস্যা তৈরী করে, যে কারনে কবি লিখেছেন, “নিন্দুক বলে চলবেই, তাকে থামাই কেমন করে”, কিন্তু আমরা যদি নিন্দুকের বিরুদ্ধে একবার রুখে দাঁড়াতে পারি তাহলে আমাদের মনের ভেতরের দুর্বলতা দূর হয় এবং আমরা সেটা করতে পারি। নিন্দুকদের ব্যাপারে আমরা সচেতন হতে পারি কিন্তু সব সময় নিন্দুকদের চরিত্র পরিস্কার করে বুঝতে পারি না, আমাদের চারপাশেই ঘাপটি মেরে থেকে, যে কারনে কবিতাটি শেষ করেছেন কবি এভাবে, “ইদানিং আমি গাঁটের টাকায় নিন্দুকপাল পালি”। আমরা অনেক সময় নিজেরাই নিজেদের নিন্দুকদের কদর করি, তাদের লালনপালন করি নিজেদের অর্থে এবং শ্রমে, যেটা এক চরম বাস্তবতা।
আসরের সবার প্রিয় এবং পরিচিত কবি ফারহাত আহমেদ, অসাধারন তার লেখনি এবং তিনি খুব ভালো একজন সংগঠক। তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করলাম, একটু সাহস নিয়েই, ভুল হলে মাফ করবেন কবি। সবশেষে শুভেচ্ছা রইলো।
কেউ নাই
- ফারহাত আহমেদ
কেউ নাই,
কেউ থাকার কথা না,
"কেউ নাই" তাই বলছি,
অন্তরে তুমি,
তোমাকে লুকিয়ে,
এইভাবে আমি চলছি।
বলতে পারি না
- ফারহাত আহমেদ
বলতে পারি না, আমি যা জেনেছি
বললে বানাবে ভর্তা,
সভাপতি মেরে সহসভাপতি
এখন হর্তা কর্তা।
বলতে পারি না কপিক্যাট কানা
পদ্মলোচন বানায়,
সারাটা জীবন বদনা বানিয়ে
বালতি বানায় জানায়।
রাজাকার ছিলো চক্ষের বিষ
দৌড়ের মাঝে রাখি,
বলতে পারি না, এখন তাদের
জ্বালায় দৌড়ে থাকি।
ঠিকানা
- ফারহাত আহমেদ
পাখিরা কখনো ঠিকানা চায় না,
উড়ে চলে নিজ খেয়ালে,
এক পাখি তবু ঠিকানা চাইলো
খেয়ালে বা বেখেয়ালে।
সঙ্গে সঙ্গে দিলাম ঠিকানা
যদি পাখি কিছু বলে,
আসে না, বলে না, লেখে না, তবুও
আশার প্রদীপ জ্বলে।
অতলে
- ফারহাত আহমেদ
সযতনে আমি নৌকা চালাই
ডুবতে চাইনা বলে,
কেউ যেন রোজ করছে পরখ্
অতল জলের তলে।
অতল জলকে ভয় হতো বড়ো,
না জানি কি আছে সেখানে,
জলকন্যাকে দেখে নামি জলে
হাবুডুবু ভয় যেখানে !
আনমনা হয়ে পরখ্ করছে,
দেখে যাই চুপি চুপি
তোমার অতলে হাসতে হাসতে
আমার নৌকাডুবি।
নিন্দুকপাল
- ফারহাত আহমেদ
বিষয় নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা
ঘামাই জীবন ধরে,
নিন্দুক বলে চলবেই, তাকে
থামাই কেমন করে ?
নিন্দুক যদি "পারবে না" বলে
ওটাই যখন পারি,
বিনে পয়সার এমন মোষকে
ক্যাম্ নে তখন মারি ?
নিন্দুক আর মাথাব্যথা নয়,
সে গুড়ে অনেক বালি,
ইদানিং আমি গাঁটের টাকায়
নিন্দুকপাল পালি।