আনন্দ নিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়
মাস্টারশাই প্রতিদিনের মতই খাতার দিকে চেয়ে
আপন মনে রোল কল করে চলেছেন।
রোল নাম্বার এক, রোল নাম্বার দুই......
উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী কেউ বা 'ইয়েস স্যার'
কেউ কেউ 'হাজির স্যার' বলে সাড়া দিচ্ছে।
ব্যতিক্রম ঘটে রোল নাম্বার আঠারোতে এসে।
মাস্টারমশাই "রোল নাম্বার আঠারো,
রোল নাম্বার আঠারো" বলে বিরক্ত হয়ে
ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন- "শিবরাম স্কুলে
আসছে না কেন বল দেখি? আজ সাত দিন হলো।
মাথাটা তো খারাপ তা নয়
কেন যে স্কুলে আসতে চায় না কে জানে!
আজ খাতা আনেনি, কাল পেন আনেনি বলে
অজুহাতের পর অজুহাত শুধু।"
ক্লাসের এক ছাত্র নিখিল বলে উঠল-
-ওর তো জ্বর মাস্টারশাই,
জ্বরের ঘোরে শুনলাম প্রলাপ বকছে।
-তা ডাক্তার দেখায় নি? ওষুধ খাচ্ছে না?
- ওদের তো অর্ধেক দিন রান্নাই হয় না মাস্টারমশাই
ডাক্তার, ওষুধ-পথ্যর জন্য টাকা পাবে কোথায় !
- কেন? এত ভারি আশ্চর্যের কথা!
-ওর যে বাবা নেই মাস্টারমশাই, ওর মা
দু-চার বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়।
মাস্টারমশাই কয়েক মুহূর্ত মৌন থেকে
নিখিল কে বললেন, "ছুটির পর একবার
নিয়ে যাস তো ওদের বাড়ি।"
নিখিল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ছুটি যখন হলো তখন বিকেল চারটে।
মাস্টারমশাই নিখিলকে নিয়ে চললেন-
স্কুল থেকে শিবরামের বাড়ি মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ।
আকাশটা আজ কেমন যেন মেঘলা, আঁধার।
শিবরামের বাড়ি পৌঁছলেন যখন তখন দু-এক
ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
তাদের নিচু দরমার, টালির চালের ছোট্ট এক বাড়ি
বাইরে থেকে ডাকলেন শিবরাম? শিবরাম?
ভেতর থেকে শিবরামের মা মাস্টারমশাইকে
বললেন," ভেতরে আসুন মাস্টারমশাই।"  
মাস্টারমশাই ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলেন
একটা কেরোসিনের বাতি টিম টিম করে জ্বলছে,
কয়েকটি বই খাতা ইতস্তত ছড়ানো।
একটা তক্তপোশে পুরানো কাঁথা গায়ে
শুয়ে আছে শিবরাম, প্রায় চেতনা হীন
জলপটির সরঞ্জাম তার মাথার কাছেই।
জ্বর কমাতে তার মা জলপটি দিচ্ছিল বোধ হয়।
তার মাথায় স্নেহের হাত বোলাতে বোলাতে
মাস্টারমশাই শিবরামের মা'র কাছে চিকিৎসার
ব্যাপারে জানতে চাইলেন।
তার মা  সসঙ্কোচে মৃদুস্বরে বললেন -
"কোথায় টাকা পাব মাস্টারমশাই?
ঠিক মত খাবার জোটে না, ছেলেটার পড়ার
খাতা পেন বই-ও জোগাড় করতে পারি না।
আমি কাজে গেলে ঘরে বাইরের কাজ যে
ওকেই করতে হয়, তাই রোজ স্কুলেও
যেতে পারে না ছেলেটা।"
এসব দেখে শুনে মাস্টারমশাই-এর মন
কেমন যেন অস্থির, ভারাক্রান্ত  হয়,
ছলছল করে ওঠে দু চোখ।
মাস্টারমশাই অনুভব করেন শিবরামের
স্কুলে অনিয়মিত, অমনোযোগের  কারণ।
নিজেকে সামলে সে পকেট থেকে বেশ কিছু
টাকা বের করে তার মায়ের হাতে দিয়ে বললেন-
"ওকে ডাক্তার দেখিও, ওষুধ পথ্য কিনে দিও,
আর ওর পড়াশোনার খরচও আমি বন্দোবস্ত
করে দেব, সুস্থ হলে ওকে নিয়মিত স্কুলে পাঠিও।"
মাস্টারমশাই যখন শিবরামের বাড়ি থেকে বেরোলেন
তখন মেঘ কেটে গেছে,বৃষ্টি থেমে গেছে
সূর্য অস্ত গিয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে।
মাস্টারমশাই আনমনে চলেছেন আলোর সন্ধানে।