শুক্রবারে নামাজের পরে এমনিতেই আমার ঘরে ফিরতে বেশ দেরীই হয়ে যায় --অনেকের সাথে কুশল বিনিময় করতেই হয় । আজ আমার তাড়া বড় --হাকিম চত্বরে পৌঁছতে চাই তিনটার আগেই। কিন্তু হলো না -- নাকে মুখে একটু গুঁজে রওয়ানা হতে হতেই তিনটা বিশ -- মন খারাপ হয়ে গেলো। দীর্ঘ কয়েক যুগ পর যখন চিরচেনা ‘হাকিম চত্বর’-এ নামলাম - নস্টালজিয়া আমাকে ঘিরে ধরার আগেই- কবি-সভায় উপস্থিতির তাগাদা আমাকে উদ্বেল করে তুললো। ঘাস ছাওয়া সবুজ চত্বরে আমার চোখ খুঁজছে একটা দশাশই জটলা --আছে তো ---ঐ বড় গাছটার উত্তর দিকেই। ছুটলাম দ্রুত বেগে --গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জটলাতে শামিল হতেই ,হাতে চকলেট ধরিয়ে দিলো কেউ।পরিচয় পর্ব চলছে --আমার মুখ চেনা অনেকেই আছেন কবীর ভাই , পলক ভাই , তাজুল ভাই । খায়রুল আহসান ভাইকে চিনতে কোন অসুবিধাই হলো না ,সপ্রতিভ শ্মশ্রু -মণ্ডিত কবি আনিছুর রহমান মনোযোগ টানবেই --হাতে তার নিজের প্রকাশিত গুটি কয় কবিতার বই ।কার হাত থেকে যেনো “শতরূপে ভালোবাসা”-র একটা কপি বের হলো--সবাই হাতে নিয়ে দেখছে আমাদের ‘নবান্ন’ --চোখে মুখে অমৃত পিঠে-পুলির আস্বাদ মাখা তৃপ্তি যেন তাদের। কবি মুজিবর রহমান উড়ে এসেছেন উত্তরা থেকে --প্রথমে একটু চিন্তিতই নাকি ছিলেন এই শুভ্র শ্মশ্রু -মণ্ডিত কবি --একি শুধু নবীন কবিদের মেলা ? সবার আন্তরিকতায় পরিবেশটায় মাখামাখি হয়ে গেলেন তিনিও।খুব মাই ডিয়ার কবি কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম --বসে আছেন এক চেয়ার দখল করে হাসি হাসি মুখে --খুব উপভোগ করছেন তিনি সময়টা। শীতের বিকেল আসলেই ছোট --ইউনিভার্সিটির মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসতেই আমরা ক’জন ছুটলাম নামাজে। এসে দেখলাম আরো অনেকেই এসে গেছেন ইতিমধ্যে --কবি পার্থ সাহা, ইয়ং ম্যান ,সদা হাস্য মুখ। একদম জামাই হয়ে যেন এসেছেন কবি শিমুল দত্ত (শিমুদা) --ধবধবে সাদা পাজামা-পাঙ্গাবীতে দারুন স্নিগ্ধ ,তরতাজা লাগছে তাকে । কবি রফিক পঞ্চায়েত এসে গেলেন হাসি হাসি মুখে , খুব অবাক চোখে মগ্ন হয়ে দেখছেন কবিদের ,যেনো মনে আঁকা কবিদের ছবি মিলিয়ে নিচ্ছেন।কবি মহিউদ্দিন মাসুম খুবই তৎপর , সবাইকে টেনে নিয়ে দাঁড় করালেন ফটো-সেশানে। আমার পাশেই কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ--সদালাপী ,সজ্জন ব্যাক্তি।আমার ধারণা মিলে গেলো --ইনিই কবি জসীম উদ্দিন মুহাম্মদের ভাই । এর মাঝেই কবি শিমুল শুভ্র এসে গেছেন --সবার হাতে তিনি ধরিয়ে দিলেন --‘অর্ঘ্য’ --আমরা অটোগ্রাফ নিতে ব্যাস্ত হলাম। কাজের কথা এগুচ্ছে না --কবিরা নিজেদের মধ্যেই মশগুল । হাতে হাতে ঘুরছে একটা বড়সড় রেজিস্টার খাতা ,যার পাতায় পাতায় এ বিকেলের অনুভূতি লিখে চলেছেন কবিরা একে একে , এ উদ্যোগটা পলক ভাইয়ের -সাফল্য মণ্ডিত এক আয়োজন। পলক ভাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়া মেয়ে তারান্নুম এসে সবার সাথে পরিচিত হলো এক ফাঁকে । কবি জাহিদ ভাই এসেছেন বোধহয় সবার শেষে , উনিই কোন এক ফাঁকে চায়ের অর্ডার করে এলেন --এসে গেলো লাল চা , দুধ চা , যে যেটা নাও । কবি ওনীল ওসমান (সিমন) এলেন --আনন্দে দিশেহারা। এক ফাঁকে আমার সাথে আলাপ হলো অনেকক্ষণ --খুবই সিরিয়াস কবি । এবার ফাঁকে ফাঁকে কাজের কথা চলছে--১৪ তারিখে কিভাবে কি করা যাবে , কাকে আনা যাবে মোড়ক উন্মোচনে , মিডিয়া কাভারেজ ইত্যাদি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বই মেলা --এখান থেকে শ’ পাঁচেক গজ দক্ষিণে যাত্রা--অতি দুর্গম তা। সেদিকে অগ্রসর হতে যেয়ে বেকুব হতে হলো--প্রচন্ড ভীড় --সারা ঢাকা যেনো ছুটছে মেলা অভিমুখে । হাত-পা ঠিকঠাক জায়গায় নিয়ে কোনো মতে ঢুকলাম মেলার ভেতর। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি পরস্পর থেকে --লোকারন্যে। সবার দেখা মিললো -- ‘জাগৃতি প্রকাশনী’-র সামনে। একটা প্ল্যানিং হয়ে গেল -আমাদের। এরপর পলক ভাইয়ের প্রকাশকের স্টলে ( জিনিয়াস পাবলিকেশন্স)হাজির সবাই --অনেক বই তার লেখা --ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতার বই তো আছেই--সবাই কিনছে পছন্দ মতো--কবি মহা আনন্দে অটোগ্রাফ দিয়ে চলেছেন । সেখান থেকে কবি তাজুল ইসলামের প্রকাশনী ‘সংবেদে” -আমরা -আমি নিলাম তার এ বছরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “ শূন্যতার প্রহরী ” । এবার এসেছি সবাই কবি আনিছুর রহমানের প্রকাশনী “ পূর্বা প্রকাশনী” -তে তার আছে একাধিক প্রকাশিত বই -আমি নিয়েছি ‘ আধারে কান্না হাসে ‘ ।হঠাতই কবি ওনীল ওসমান আমার হাতে তার সেল-ফোনটা ধরিয়ে দিতেই ওপাশ থেকে কবি দুর্বাসা লিটনের উচ্ছ্বসিত আওয়াজ ভেসে এলো , উনি অর্ধেক পথ এসেও ফিরে গেছেন , এখানে পৌছে কাউকে আর পাবেন না ভেবে ।বাইরে বেরিয়ে শেষ চা-চক্র --একটু দূরে বাংলা একাডেমীর মূল গেটের পাশে চায়ের সাথে তেলেভাজা চিবুতে চিবুতে আমরা পাঁচ ছ জন ভাবছি অন্যেদের কথা --দলছুটেরা কোথায়? চা শেষ শিমুল শুভ্র আর মাসুম্ ভাই ছুটলেন দুইকাদি বইয়ের বাণ্ডিল দুই হাতে ঝুলিয়ে ফার্ম গেটের দিকে।
আমি , তাজুল ভাই আর হুমায়ূন কবীর ভাই রইলাম শেষমেশ । হাঁটছি শাহবাগের উদ্দেশ্যে--আলাপে আলাপে ঘন্টা দুয়েক পার করে দিয়েছি কোন ফাঁকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই --চার রাস্তার মোড়ে অবশেষে এসে নিতান্ত অনিচ্ছায় বাড়ীর পথ ধরলাম--মনে আসছে সদ্য ছেড়ে আসা কবিদের মুখ একে একে ।
কথায় যা এনেছি তা এক সতেজ বৃক্ষের ডালপালা কেবল -- তার সতেজ সবুজ পত্র-পল্লব যে বসন্ত ( আমরা যেনো বসন্তেই ছিলাম!) বাতাসে দুলেছিলো তা অনুভবই করা যায়, ভাষায় আনার সাধ্য কি আমার আছে ?