কথা চলছে টুকটাক করে কবিদের মধ্যে , কবীর ভাইয়ের ফোনে মাঝে মাঝেই কল আসছে , কেউ কেউ ওপাশ থেকে লোকেশন জেনে নিচ্ছেন। চলছে অব্যাহত আগমন কবিদের টেবিলে জুড়তে হচ্ছে আরো চেয়ার। কবি মোঃ জামান আহমেদকে পেলাম আমার কাছেই বসা – পাঞ্জাবী পড়ে রীতিমত কবিভাব নিয়েই এসেছেন তিনি, এ কবি-বন্ধুটি বয়সে একেবারেই তরুণ –সদ্য পাশ করা –সদা-হাস্য মুখ, প্রবল উচ্ছ্বাস তার এই আসরে এসে-তার লেখনীর ভারিক্কী দেখে আমি আগে ভেবেছিলাম ভারি বয়সের কেউ হবেন। বিষ পিঁপড়ে (তাইবুর রহমান) ধারালো ব্যক্তিত্বের , অমায়িক ছিপছিপে তরুণ—এখনো পড়ছেন । পরিচয় পর্বে জানা গেলো ছেলে বয়সে তার লেখার অদম্য স্পৃহা দেখে তার বাবা তাকে খাতা কিনে দিয়েছিলেন কবিতা লেখার। এতো অল্প বয়সে এতো গুরু-গম্ভীর , বস্তুনিষ্ঠ লেখেন বিষ পিঁপড়ে হয়তো পিতার এই বিশাল আশীর্বাদ সাথে আছে বলেই।তবে সব ছাপিয়ে তার প্রচণ্ড আগ্রহী আর উৎসাহী মনোভাব , আসরের জন্য কিছু করার উদগ্র বাসনা সবাইকে ছুঁয়ে যায় ।
এম,এইচ, মিঠু –ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে বিজ্ঞ চেহারার নাদুস –নুদুস ভদ্রলোক, জাপানীদের সাথে প্রজেক্টে আছেন বলেই বোধহয় একটু জাপানীদের মতোই লাগছে তাকে –বেশ কিছু সামাজিক কার্যক্রমে তিনি জড়িত, অনায়াসে নিজের ধারণা গুলো অন্যদের মাঝে প্রকাশ করতে সক্ষম।তার অভিজ্ঞতার প্রাঞ্জল বর্ণনা আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই।
সামিন রহমান শশ্রু - মণ্ডিত, অত্যন্ত সিরিয়াস চেহারার কবি, আমার লাইনেই তিনি বসেছিলেন তিনজনের পরে , খুব স্পষ্ট করে তার বক্তব্য আমি শুনতে পারিনি।একটা এড্রেসিং মাইক্রোফোনের অভাব অনুভব করেছি আমরা সবাই।দূরান্তে বসা অনেক কবির গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হাসি হাসি মুখ করে শুনে গেছি , আমি লীপ-রিডার নই , এটা শেখার গুরুত্ব টের পেলাম।কবি আজিজুল হক বসেছেন ঠিক আমার পাশেই, মিতবাক কিন্তু ভীষণ আন্তরিক। বেশ পরিপাটি এ কবিকে ফর্মাল ড্রেসে দেখে মনে হলোএই মাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন—তবে তিনি, ক্লান্ত নন বরং বেশ উজ্জীবিত ।পরে অবশ্য বিদায় বেলায় বেশ কথা হলো। কবি আলমগীর সরকার লিটন এসেছেন একটু দেরী করে, বেশ উদ্যমী এক তরুণ।বার বার বক্তব্য রেখেছেন গঠনমূলক, চিন্তা প্রদায়ক , সবার বক্তব্য আত্মস্থ করেছেন গভীর মনোযোগে।
আমরা কথা গিলছি সবার গোগ্রাসে , খিদে ভুলে, অনেকক্ষণ হলো চায়ের কথাও কেউ তুলছে না, পানির বোতলগুলো পর্যন্ত অবহেলায় দাঁড়িয়ে টেবিলের এককোণে , চুপচাপ, কবিরা নিজেদের নিয়েই মশগুল।
কবীর ভাই খাবারের অর্ডার দিবেন –জেনে নিচ্ছেন সবার পছন্দ –অপছন্দ। আমি সটকে পড়লাম- একটা সিগারেট না ধরালেই নয়।
ফিরে এসে দেখি অর্ডার সার্ভ করা হয়েছে –সবাই সামনে জীভে-জল আনা আইটেম নিয়ে বসে আছে—আমি কিন্তু পাঠককে কিছুতেই এর বিস্তারিত বলবো না—ভাগ্য বিড়ম্বিত অনেক কবির অভিসম্পাত বয়ে বেড়ানো ভালো কথা নয় ।
“ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য” টাইপ মনোভাব নিয়ে আমি প্লেটে ঝাপ দিলাম।
সবার আগে কবি আলামীন সজীব জানালো। ‘আমার শেষ ,আমি উঠছি’।আর সবার শেষে তাড়িয়ে তাড়িয়ে হাড্ডি চিবুতে চিবুতে কবীর হুমায়ূন ভাই বললেন , “ কি ব্যাপার আমিই কি সবার শেষে ?” কবীর ভাইয়ের পাশে নেক্সট টাইম বসতে হবে , আমিও স্লো ইটার।
এই ফাঁকে মোঃ রাশেদুল ইসলামের কথা বলি, এই কবিবন্ধু বিশেষ পেশায় আছেন, অসম্ভব ঠাণ্ডা মানুষ , একেবারে আইসক্রিম,শুধু তার সদা চঞ্চল চোখে গভীর আগ্রহের ,উৎসাহের খেলা দেখলাম বার বার ।
সবশেষে বলছি সাবলীল মনির ভাইয়ের কথা , ঝক ঝকে ফ্রেশ লুক, দীপ্তিমান মুখাবয়বে তার প্রমিন্যান্ট ভ্রু-যুগল আর তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বলে দেয় – এই সেই প্রতিবাদী , বলিষ্ঠ চেতনার , সফল সাহস সঞ্চরক কবি ---সাবলীল মনির। (ওহহো কবি সরকার মুনীরের কথা তো বলাই হলো না , এই ভদ্রলোক তার নিজের প্রকাশিত কবিতার বইটি প্রত্যেক কবিকে অটোগ্রাফ দিয়ে বিলচ্ছেন , পরিচয় পর্বে তিনি স্বরচিত কবিতা পাঠের সৌভাগ্য লাভ করলেন , তবে অনেকের কানেই তার লো ভলিউমের পাঠ পৌঁছুল না।)
আসর ভাঙ্গতে গিয়ে আমরা যেন ল্যাথারিজমে পতিত হলাম। ‘আজকে এখানেই থেকে যাই না ‘এমন একটা ভাব সবার ।কবীর ভাই বললেন , “এর পর এই হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের দেখলে আর ঢুকতেই দেবে না এখানে ।“
উড়ে চলা কয়েকটি ঘণ্টা শেষে আমরা ধীর লয়ে নীচে চওড়া লবিতে পৌঁছলাম ---এখানে ফটো –সেশান হবে – সবাই ঝিমঝাম দাঁড়িয়ে গেলো । একটা বিশাল কাব্যিক সম্প্রীতি ফ্রেম-বন্দী হলো।
আমি দেখেছি সৃজনশীল মানুষেরা প্রায়শ ইগো-সেন্ট্রিক হয়, আমার ধারণাকে ভুল প্রতিপন্ন করে বাংলা কবিতা আসরের কবিরা যে আন্তরিকতা , পারস্পরিক সম্মান, সম্মিলিত পরিকল্পনায় উৎসাহ দেখালেন –যেভাবে ছোট –বড় সবাই এক সত্তায় অভিযোজিত হলেন – সত্যিই বিমোহিত হতে হয় !
ভালও থাকুন কবি বন্ধুরা । বাঁচিয়ে রাখুন বাংলা কবিতাকে –সভায় আসতে পারা ,না পারা মুক্ত মনের শুদ্ধ প্রাণের এই সময়ের কবিগণ –সময় আপনাদের মনে রাখবেই ।