নমস্কার কবিবন্ধুরা,  

সকলে ভালো আছেন তো ?  বাংলা কবিতায় সংস্কৃত ছন্দের আলোচনার পাতায় আবার আপনাদের স্বাগত জানাই !

এর আগে প্রথম কিস্তিতে আমি সংস্কৃত মন্দাক্রান্তা ছন্দের ব্যাবহার, গঠণপ্রনালী, ও প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু সত্যি বলছি রেসপন্স তেমন পাই নি, যতটা আশা করেছিলাম।  জানি না, আলোচনাটা সবার হয়ত ভালো লাগে নি, অথবা, আমিই হয়ত সেরকম ভাবে বুঝিয়ে উঠতে পারি নি, তবে আমার যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল যতটা সরল করে এই ছন্দের প্রয়োগ বা গঠন আলোচনা করা যায়।

তবুও যারা উৎসাহ পেয়েছিলেন বা আমায় উৎসাহ দিয়েছিলেন আমার এই বিষয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার জন্য, তাদের কথা মনে করেই আবার আমার ফিরে আসা, বাংলা কবিতায় সংস্কৃত ছন্দের দ্বিতীয় ভাগ নিয়ে।  

আজকের আলোচনাতে আমরা দেখব, আর এক সংস্কৃত ছন্দ  “তোটক" বা "তোটকম” কি, এবং বাংলা কবিতায় এই ছন্দের ব্যবহারিক প্রয়োগ ।

এর আগের আলোচনাতেই বলেছি বাংলা ভাষায় ব্যবহূত সংস্কৃত ছন্দ গুলির কথা। সংস্কৃত ছন্দগুলির প্রত্যেকের একে অন্যের থেকে আলাদা হবার কারণ হল এর মাত্রার ব্যবহার ও উচ্চারণের রীতিতে লঘু ও গুরুস্বরের শ্বাসের বিভাজন।

আমরা প্রথমে মাত্রা সম্পর্কে একটু জানি, তাহলে ব্যাপারটা আরো খোলসা হবে বলে আশা করি।  মাত্রা ব্যাপারটা আমরা সবাই জানি যে, এটি শব্দের বানানের উপরে নির্ভরশীল নয়, উচ্চারনের সময়সীমার একক হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

উচ্চারণের কালপরিমাপ সম্পর্কে তন্ত্রসারে উল্লেখ আছে –

"বামজানুনি তদ্ধস্তভ্রমণং যাবতা ভবেত্।
কালেন মাত্রা সা জ্ঞেয়া মুনিভির্বেদপারগৈঃ।।"

অর্থাৎ বামজানুতে একবার হাত বোলাতে যতখানি সময় লাগে, ততখানি সময়কে বেদজ্ঞরা একমাত্রা বলে ধরে থকেন। হাঁটুর বানানের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। প্রতিটি বররণেরই উচ্চারণ একমাত্রা, দুমাত্রা বা তিনমাত্রা হতে পারে।]

মাত্রার সংখ্যাগণনার উপায় এই রকম -

"একমাত্রো ভবেদ্ হ্রস্বো দ্বিমাত্রো দীর্ঘ উচ্যতে।
ত্রিমাত্রস্তু প্লুতো জ্ঞেয়ো ব্যঞ্জনমর্ধমাত্রকম্।।"

মানে, হ্রস্ব বর্ণগুলির একমাত্রা, দীর্ঘ বর্ণের দুইমাত্রা, প্লুতোর (সম্বোধন পদের) তিনমাত্রা এবং স্বরবিহীন ব্যঞ্জনের (ক্ প্রভৃতি) অর্ধমাত্রা ধরা হয়। সুতরাং বর্ণমাত্রই একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক হতে পারে।

মাত্রা তো হল, এবার চলুন যাই দীর্ঘশ্বাস ও হ্রস্য শ্বাস কি এবং ব্যবহারের রীতি ও ভীতি দেখতে । যদিও আগেই বলে দিই যে সকলেরই একটা প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন  ধারণা আছে যে, সংস্কৃতি রীতি অনুসারে হ্রস্য ও দীর্ঘশ্বাসের ব্যাবহার বাংলা ভাষাতে সুচারু ভাবে সম্পন্ন করার অসুবিধা আছে, উচ্চারণরীতির জন্য, এবং এই জন্যই বাংলা ভাষাতে পুরোপুরিভাবে সংস্কৃত ছন্দের কবিতা দেখা একটা বিরল ঘটনার মধ্যে পড়ে। কিন্তু সত্যি কি তাই ? যদি বলি পুরোপুরি কথাটা ঠিক নয় ? কি বিশ্বাস হচ্ছে না তো ?  তাহলে আসুন আমরা দীর্ঘ্স্বর ও হ্রস্যস্বরকে আরো একটু কাছে থেকে দেখি যদি এর কোনো সমাধানসূত্র পাই -  

বাংলা ভাষাতেও আমরা গুরু ও লঘু স্বরের তফাত করে থাকি, কিন্তু হয়ত অবচেতন মনে করা বলেই সব মনেও থাকে না হয়ত ।

একটা উদাহরণ দিলে হয়ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে –
যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, “তুমি কি খেলে ?” আর “তুমি কী খেলে ?” তাহলে বন্ধু আমরা সকলেই প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব খেয়েছি কি খায়নি, আর দ্বিতীয়টার উত্তরে বলব কি কি পদ খেয়েছি, তাই না ? প্রথম "কি" আর দ্বিতীয় "কী" কে আমরা কি একরকম উচ্চারণ করব নাকি এদের অর্থও এক করে বলব ? নিশ্চয়ই না তাই না ?  

তাহলে দেখছেন, এখানে “কি” হচ্ছে হ্রস্য স্বর যা বাংলায় রুদ্ধ দল, আবার “কী”- যা দীর্ঘস্বর বা বাংলায় মুক্ত দল হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

সমস্ত আ-কার, এ-কার, ও-কার, ঈ-কার, ঊ-কার কে বাংলায় দীর্ঘস্বর বা শ্বাস এবং ই-কার, উ-কার, এ-কার কে উচ্চারণের রীতি অনুযায়ী হ্রস্যস্বর বা শ্বাস বলে কবিতায় চালানো গেলে সহজে এই সমস্যার সমাধান করা হয়তো সম্ভব।  আগের সংখ্যাতে বলেছি যে সংস্কৃত ছন্দ কবিতায় একটা বিশেষ তাল অনুসরণ করে চলে, তবে ছন্দের মাপকাঠিতে তাকে তা বিভিন্নভাবে সাজানো হয়।

তাহলে আমরা সংস্কৃত ছন্দের মাত্রাজ্ঞান অর্জন করলাম কি বলেন ? এর ছন্দের ও শব্দের উচ্চারণ প্রণালীর গুরু - লঘু যোগ সম্পর্কেও কিছূটা ওয়াকিবহাল হলাম ।

এবারে আসি চলুন দেখে নিই, বাংলা কবিতায়, তোটক বা তোটকম ছন্দের কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগ । তোটক ছন্দকে যদি আমরা একটু তালের হিসাবে ভাঙ্গি, তাহলে দেখতে পাবো, এটি খুব সুন্দর, সহজ ও গতিশীল ভাবে বিস্তার লাভ করেছে প্রতিটি চরণে,

তাতা ধিনতাতাধিন / তাতা ধিনতাতাধিন – শুধু চরণের শেষে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। সেই ছাড় এই ছন্দকে দেওয়া আছে ছান্দসিকদের দ্বারা । বলাবাহুল্য এখানে -

তা – মুক্তদল বা স্বর ( উচ্চারণে – দীর্ঘশ্বাস)
ধিন – রুদ্ধদল বা স্বর ( উচ্চারণে – হ্রস্যশ্বাস)

কবিতায় চট করে এর প্রয়োগ দেখে নিই একবার -

কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ- এর নাগপঞ্চমী কবিতা থেকে একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে –

প্রিয় আজকে আমার /শুধু ভাঙছে দুয়ার
(তাতা ধিনতাতাধিন /তাতা ধিনতাতাধিন)

ধু ধু উড়ছে পরাগ /কালো পাগলা ঝড়ে
(তাতা ধিনতাতাধিন /তাতা ধিনতাতাধিন)

বুকে বর্শা-সমেত / ছোটে মত্ত শুয়ার,
(তাতা ধিনতাতাধিন /তাতা ধিনতাতাধিন)

তত শুক্র উছল, / যত রক্ত ঝরে।
(তাতা ধিনতাতাধিন /তাতা ধিনতাতাধিন)

কবি অমিতাভ মালাকারের কবিতা  -  

এ মনুষ্যজনম কত জীর্ণ হবে?
কত সইবে এমনতর হীন অপমান?

আপনারা একবার দেখতে পারেন এতে এই ছন্দ যাচ্ছে কিনা।

এছাড়া, সবচেয়ে বড় উদাহরণ -
কবি দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার রচিত বিখ্যাত বহুপ্রচলিত একটি গান – “ভবসাগর-তারণ-কারণ হে” বাংলায় সংস্কৃত তোটক ছন্দের এক স্বার্থক উদাহরণ।  অনেকেই গানটি শুনে থাকবেন । তাই আর গানটি লিখে লেখাটা লম্বা করলাম না । উপরে উল্লিখিত তাল অনুযায়ী ও মুক্তদল ও রুদ্ধদলের পারফেক্ট কম্বিনেশনে এ গান লেখা।

আজ এই পর্যন্তই,  এর পড়ে আবার কোনো একদিন আপনাদের সামনে অন্য কোনো সংস্কৃত ছন্দকে ধরে বেঁধে হাজির করাব, সেই ইচ্ছা প্রকাশ করে এখানেই আজকের আলোচনা শেষ করছি।  একটাই লক্ষ্য যদি ভবিষ্যতে আমরা এইসব ছন্দ নিয়ে নিজেরা কিছু রচনা করতে পারি, আর তাতে আমার এই লেখা কোনরকম সাহায্য করতে পারে, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

** কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ বা কবি অমিতাভ মালাকার আজকের যুগের কবি। ওনাদের ফেসবুক প্রোফাইলেও এরকম আরো কবিতা  পাওয়া যাবে। আমি কৃতজ্ঞ এনাদের কাছে, এই সম্পর্কে জানবার আর জানাবার জন্য। এনারা যদি চেষ্টা করতে পারেন, তাহলে আসুন না, আমরাও একবার চেষ্টা করে দেখি। তাহলে এনাদেরকেও যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করা যাবে বলে মনে হয়।

আজকের আলোচনা আপনাদের আলোচনা কেমন লাগল জানাবেন আশা করি। ভালো থাকুন, অগ্রিম শুভ বড়দিন সকলকে -



**
( কৃতজ্ঞতা স্বীকার - ইন্টারনেট, উপরে উল্লিখিত কবিরা ও তাদের লেখনী, তন্ত্রসার ইত্যাদি )