ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো
শংকর ব্রহ্ম


                      কবি 'ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো' নিজের মিউজিয়াম তৈরি করে গিয়েছেন।দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন প্রায় পঁচিশ বছর আগে।সেখানেই মারা গেলেন গত ১লা এপ্রিল ২০২১ সালে। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো আজও রুশ কবিতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

ইয়েভতুশেঙ্কো কবিতা

‘বাবি ইয়ার’ কবিতা:

‘বাবি ইয়ারের মাথায়
স্মৃতিস্তম্ভ নেই কোনও
খাড়া পাড় সোজা
নেমে গেছে নীচে
... দেখে ভয় হয়, মনে হয় বুঝি
ইহুদি জাতির মতো আমিও নিজেই
বুড়ো হয়ে গেছি।’

প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠছে ট্রাজেডির দৃশ্য।


               'বাবি ইয়ার' ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একটি গভীর খাত। ১৯৪১-এর ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযানে নাৎসিরা এই অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসী ও পুলিশের সহায়তায় ৩৩,৭৭১ জন ইহুদিকে হত্যা করে ওই খাতে ফেলে দেয়। এত অল্প সময়ে,এক দফায় এত বেশি সংখ্যক ইহুদি নিধনের ঘটনা আর কোথাও কখনও  ঘটেনি। ঘটনাটি ভীষণ স্পর্শকাতর, স্থানীয় অধিবাসীরা এতে জড়িত ছিল। ফলে সোভিয়েত আমলে এর উল্লেখও নিষিদ্ধ ছিল।

               ১৯৬১ সালে ইয়েভতুশিয়েনকোর এই কবিতা প্রকাশের পরই ঝড় ওঠে।ইহুদি-বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেওয়ায় কবি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের শুধু নিন্দাই করেননি। আরও বলেছেন, এই গোপনীয়তার অর্থ নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো। ক্রুশ্চেভের আমলে এর সোভিয়েত প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
             পার্টি নেতৃত্ব জানালো,রাজনৈতিক অপরিপক্বতা। রাজনৈতিক বোধের অভাবেই নাকি কবি,দুনিয়ার অন্য নাৎসি শিকারের কথা বলেননি,বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘বাবি ইয়ার’-এর কথাই শুধু  বলে ছেড়ে দিয়েছেন।

         এই কবিতাই তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দিল। এর ভিত্তিতেই সিম্ফনি রচনা করলেন সুরকার 'দ্ মিত্রি সাস্তাকোভিচ'।বিশ্বের ৭২টি ভাষায় অনূদিত হল ‘বাবি ইয়ার’। কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাই করে রাখা হল আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-র হলোকস্ট মিউজিয়াম-এর দেওয়ালেও। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরই  ইয়েভতুশেঙ্কোকে করে তুলল রুশ কবিতার ‘অ্যাংগ্রি ইয়াং ম্যান।’
            কিন্তু শাসকের রাজনীতি অন্য রকম।দেশে উদারনীতির হাওয়া বইতে শুরু করেছে,দেখানোর জন্য ক্রুশ্চেভের আমলে বারবার এই ‘রাগী ছোকরা’কে বিদেশ সফরে উৎসাহ দেওয়া হল। ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াতে কবি তখন সরকারের প্রায় প্রতিনিধিস্বরূপ। এখানেই পূর্বসূরি মায়াকোভ্স্কির সঙ্গে তাঁর তফাত। মায়াকোভ্স্কির পক্ষে ‘রাগী ছোকরা’র ভূমিকা এবং একই সঙ্গে ‘রুশ প্রলেতারীয় লেখক সমিতি’-র নেক-নজরে থাকা সম্ভব ছিল না, সোভিয়েত সাহিত্যের উপদলীয় কোন্দলে পড়ে শেষে আত্মবলি দিতে হয় মায়াকোভ্স্কিকে। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর তাঁর পরের প্রজন্মের কবি,তাঁর মেজাজ-মর্জি অন্য রকম।

              ফের দুঃসাহসের পরিচয় দিলেন তিনি। ১৯৬৩-র ফেব্রুয়ারিতে বেরলো তাঁর আত্মজীবনী। বিদেশ সফরে গিয়ে কবি যে সব সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন,তারই ভিত্তিতে লেখা স্মৃতিকথা।একে সোভিয়েত সরকারের বিনা অনুমতিতে সাক্ষাৎকার,উপরন্তু কমিউনিস্ট যুবসংঘ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য। ফের সরকারি সমালোচনার ঝড়।  
             ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো পাকা রাজনীতিবিদের মতো সেই সব লেখার দায়িত্ব অস্বীকার করলেন।পরে ‘ব্রাত্‌স্ক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র’ ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির অন্তরালে’-র মতো রাজনৈতিক প্রচারধর্মী কবিতা রচনা করে সরকারের ক্ষতি পূরণ করলেন।
            ইয়েভতুশেঙ্কোকে বুঝতে পারা সত্যিই খুব মুশকিলের ! নইলে এত সম্মান পেয়েও কেন শেষপর্যন্ত ইয়েল্তসিনের আমলে সপরিবার দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন আমেরিকায়? অভিমানে? হয়তো বা। সোভিয়েত আমল থেকে গর্বাচেভ, ইয়েল্তসিনের সময়েও তিনি হরেক রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগেও (১৯৮৭ থেকে ’৯১ পর্যন্ত) সোভিয়েত পার্লামেন্টের সদস্য।প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই সুযোগ বুঝে কখনও প্রতিবাদী,আবার কখনও  নীরব।

          ভাঙনকালে সবই অনিশ্চিত। নব্বইয়ের দশকে তাই বিদেশে আশ্রয় নেওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন তিনি। ভুল করেননি। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্ক দেশ ছাড়লেন,তার কয়েক বছর পর স্বদেশে ফিরে এলেন সলঝেনিতসিন।কিন্তু কয়েক বছর পর মস্কোয় বসে তাঁকে আক্ষেপ করতে হল, ‘আজ আর কথা বলতে কোনও বাধা নেই,কিন্তু কথা শোনার লোকের বড় অভাব।’সলঝেনিতসিন-ই সে দিন দেশে ফিরে ভুল করলেও কবি ইয়েভতুশিয়েনকো করেননি।

         ইয়েভতুশেঙ্কো বিদেশে থাকলেও,কিন্তু প্রায়ই তিনি দেশে আসতেন,পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতেন।তাঁর ধারণা,সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রুশ কাব্যজগতের ঘোর সঙ্কট।ইয়েভতুশেঙ্কো রুশ কবিতার এক সুবিশাল সংকলন : 'রুশ কাব্যের দশ শতাব্দী’ নামে হাজার বছরের কবিতা সংগ্রহ বিদেশে বসেই সম্পাদনা করেছেন।

             ২০১০ সালে মস্কোর কাছে তাঁর নিজের মিউজিয়াম উদ্বোধন করে গিয়েছেন কবি নিজেই। সেখানেই সংরক্ষিত আছে তাঁর পাণ্ডুলিপি,চিঠিপত্র প্রভৃতি সবকিছু।আমেরিকা থেকে তাঁর মরদেহ সেখানে এনে সমাহিত করা হবে,এই চুক্তিও তিনি করে গিয়েছিলেন সরকারের সঙ্গে।গতবছর (২০২১ সালে) পয়লা এপ্রিল আমেরিকায় তাঁর মৃত্যু হয়,তার আগে এ ভাবেই নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে গিয়েছিলেন।তিনি তো আর আত্মঘাতী মায়াকোভস্কি নন!
               ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো হচ্ছেন সেই ধরণের মানুষ,যাঁদের বেলায় বয়স দিয়ে (যাপিত জীবনের) হিসাব কষে মেলানো সম্ভব নয়।তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা।এর সঙ্গে খোলা মঞ্চে তাঁর অসাধারণ আবৃত্তির গুণাবলি যোগ করলে সব অর্থেই ইয়েভতুশেঙ্কো ছিলেন একজন সম্পূর্ণ মানুষ,রুশ ভাষা না জানা সত্ত্বেও যাঁর আবৃত্তি মোহগ্রস্থ ও রোমাঞ্চিত করেছিল একসময় লন্ডনের রয়াল ফেস্টিভ্যাল হল আর নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কবিতা শুনতে সমবেত হওয়া শ্রোতাদের। আর নিজ দেশ রাশিয়ায় তাঁর কবিতা শোনার জন্য স্টেডিয়াম ভাড়া করতে হত। আর সেই স্টেডিয়াম ছাপিয়ে উপচে পড়ত কবিতাপ্রেমীদের ভিড়,সেটি আজ ইতিহাস।

              সমালোচনার তীর অবশ্য জীবদ্দশাতেই ইয়েভতুশেঙ্কোর দিকেও তাক করা হয়েছে বারবার।‘তিনি যত না কবি,তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিবিদ’—তাঁর সম্পর্কে সমালোচকদের কারও কারও মত এই রকম ছিল।পরবর্তী সময়ে তাঁকে দলত্যাগী গ্লাসনোস্তের অনুসারীও বলা হয়েছে।সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কারও কারও দৃষ্টিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বহুরূপীর সাজ ধরা পশ্চিমের দালাল।তবে রাজনীতি তাঁর কবিতায় সেই শুরুর দিনগুলো থেকেই উপস্থিত ছিল।তাঁর প্রবল আলোড়ন তোলা কবিতা ‘বাবি ইয়ার’ও তখন যথেষ্ট রাজনৈতিক।

                 নাগরিক কবি ইয়েভতুশেঙ্কোর নাগরিকত্বের পরিমাপ কোনও একটি দেশ দিয়ে করা সম্ভব নয়।সমস্ত বিশ্বকে তিনি দেখেছেন মানুষের নিবাস হিসেবে।অনুক্ষণ আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনা করেছেন,মানুষের এই আবাসভূমি একদিন হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে 'হানাহানি-মুক্ত' বিশ্ব, যেখানে থাকবে না জাতিগত ও আদর্শগত কোন ভেদাভেদ।