স্বতঃস্ফূর্ত কাব্য ও বানানো কবিতা - (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


           এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়ক।    
            উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্ততঃ আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য, একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল। কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটা হলেই ভাল। সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
             তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
              ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্রসারিত হচ্ছে।
              এই "বিশেষ জ্ঞানে"-র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে, সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
               বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
                রবীন্দ্রনাথের এই মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন -
" মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।
বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন, ব্রার্টান্ড রাসেল, প্রশান্ত মহালনবিশ, সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত সব লোক।"
               অথচ তিনি সর্বদা পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এই বোধ তার তীব্র ছিল। তার ভাষায়, "আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রয়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না।"
                কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
"কাব্যে কল্পনার ভিতর, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।"
                 কবির যেমন চিন্তা ও চেতনারএক নিজস্ব জগৎ আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাও তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে, এবং কবি তা প্রকাশ করেন, তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে। এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়, কখনও চিত্রকল্পের, কখনও রূপকের, কখনও উৎপ্রেক্ষণের, কখনও ছন্দ মাধুর্যের, কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের আশ্চর্য দক্ষতার। সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত।
                 এ'সব অনুভবের ব্যাপার, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে, ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকেই যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয়তো!

                সেজন্যই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন,
'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।'
                 যথার্থ কবির কাছে শব্দের খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
                 কথাটা যত সহজে বললাম আমি,
কাজটা মোটেই তত সহজে হয়ে ওঠে না, বরং তা খুবই কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। তার জন্য প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়," কঠিন সাধনার"।
                  অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ  কখনই করা সম্ভব নয়, বলে আমার মনেহয়।
                   এই প্রসঙ্গে ১৩৮ বছর আগে বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কি নিবেদন করেছিলেন সেটা মনে পড়ে গেল।

১।   যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।

২।   টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্য লেখে, এবং টাকাও পায়,  লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন আসে নাই।  এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লিখিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া ওঠে।

৩।   যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন,  অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।

৪।   যাহা অসত্য, ধর্ম্মবিরুদ্ধ, পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকর প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না,  সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ।

৫।   যাহা লিখিবেন,  তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন।  তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্রতী, তাহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া ওঠে না।  এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।

৬।   যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই,  সে বিষয়ে তাহার অকর্ত্তব্য।  এটি সোজা কথা, কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না।

৭।   বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থকিলে তাহা আপনিই প্রকাশ পায়,  চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্ম্মন্ কোটেশন বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না।

৮।   অলঙ্কার প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টা করিবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে, লেখকের ভান্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে -- ভান্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভান্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মত কদর্য্য আর কিছুই নাই।

৯।   যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাঠিয়া দিবে  এটি প্রাচীন বিধি।  আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভাল না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভাল লাগিবে না  --  বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে।

১০।    সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি সোজা কথায় মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন,  তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক । কেন না, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝান।

১১।    কাহারও অনুকরণ করিও না।  অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়,  গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বাঙলা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব। -- এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।

১২।    যে কথার প্রমান দিতে পানিবে না,  তাহা লিখিও না। প্রমানগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময় প্রয়োজন হয় না,  কিন্তু হাতে থাকা চাই।

বাঙলা সাহিত্য,  বাঙলার ভরসা।
এই নিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে,  বাঙলা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।

(প্রচার, ১২৯১ মাঘ, বঙ্গদর্শন)