স্বতঃস্ফূর্ত কাব্য ও বানানো কবিতা - (প্রথম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


              নতুন লিখতে আসা, তরুণ কবিদের জেনে বুঝে নিতে হবে, অণুপ্রাণিত কবিতা আর বানানো কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী ? এই সত্য বুঝে না নিলে, তা'রা সাফল্য অর্জন করতে পারবে কিনা সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
              অণুপ্রণিত স্বতঃস্ফূর্ত কবিতার পক্ষে যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব, সাজানো গোছানো বানানো কবিতার পক্ষে তা হয়তো কখনোই সম্ভব হতে পারে না।
            বানানো কবিতা অনেক সময়, আচরণে ও নির্মাণে আকর্ষণীয় মনে হতেই পারে। কিন্তু দীর্ঘকালের প্রচেষ্টায় যে কাব্য সম্পদ আমাদের অধিকারে এসেছে, তার মধ্যে শব্দসম্ভার এক উল্লেখ যোগ্য প্রাপ্তি। ফলে এই শব্দাবলী সাজিয়ে কবিতা লিখতে দেখা যায় অক্ষম কবিরাও আগ্রহ বোধ করছেন, তা'তে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু বিপদ আসে তখন, যখন সাজানো কবিতা কখনও কখনও অণুপ্রাণিত কবিতার ভেক ধরে, জন সমক্ষে হাজির হয়।
                 এই প্রসঙ্গে আখতারুজ্জান ইলিয়াস বলেছেন, আঙ্গিকের দিক থেকে আমাদের এখানে সবচেয়ে পরিণতি ঘটেছে কবিতায়। এখন পাঠযোপ্য কবিতার সংখ্যা অনেক। কিন্তু কবিতা লেখাও এখন খুব সহজ অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। ছন্দ, উপ, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্প সব তৈরি হয়ে আছে; এমনকী প্রতিবাদ ও সংকল্পের ভাষা পর্যন্ত সুলত। এগুলো একসঙ্গে অ্যাসেম্বল করতে পারলেই একটি কবিতা খাড়া করা যায়। ফলে কবিতা জীবনের স্পন্দন ও প্রেরণা থেকে বঞ্চিত। (যা আজকাল প্রায়শই ফেসবুক জুড়ে চোখে পড়ে।) শুধু তাই নয়, যখন তা'রা নানা আজগুবী অধিকারও দাবী করে বসেন। তখন এই অবস্থা মারত্মক রূপ ধারণ করে।

কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ - এর সূক্ষ্ম শ্লেষাত্মক এই কবিতাটি পড়লেই তার মর্ম উপরব্ধি করা যায় সহজেই।
------------------------------------------------------------------
" এখানে কবিতা বানানো হয়।  
সব ধরণের কবিতা।  
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।  
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।  
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।  
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।  
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।  
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।  
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।  
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,  
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,  
চোখ, মুখ, নাক, কান,  
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–  
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।  
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,  
শব্দ ও ছন্দ,  
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল  
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।  
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি  
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,  
আপনি তো জানেনই,  
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।  
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,  
বলুন?  
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।  
চমৎকার হয়েছে।  
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।  
একটু বসুন স্যার, চা খান,  
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,  
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে  
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।"
  
                  বানানো কবিতার কবিরা শব্দের মোহে আকৃষ্ট হয়ে, শব্দ বিন্যাসকেই কবিতা বলে দাবী করে বসেন। শব্দ অবশ্যই কবিতার মূখ্য অবলম্বন ও উপাদান, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শব্দই শেষ কথা নয়। এ'ছাড়া বহু বিষয় আছে যা কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য সত্য।