স্বতঃস্ফূর্ত কাব্য ও বানানো কবিতা - (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন,
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’

            এখানে আমরা লক্ষ্য করলেই দেখব, ‘নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল ব্রহ্মময়ী! শক্তিময়! কী অপরূপ শব্দ দ্যুতি-দীপ্ত!
কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। নতুন অর্থ-বলয় তৈরি করে হয়ে উঠল অসামান্য। এমনতর-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাবনা অনুযায়ী, 'তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।'

           শব্দ মহৎ শক্তিমান, কিন্ত যখন রূপ-তপস্বীর হাতে না-পড়ে, তা কোনো আনাড়ি খোদাইকরের হাতে পড়ছে, তখন তা হয়ে উঠছে শব্দের জঞ্জাল। যেহেতু যে কোনও শব্দের সাথে যে কোনও শব্দ যুক্ত করে দেবার অধিকার তাঁর আছে, এবং আলাদাভাবে কবিতায় গভীর কোনও ইঙ্গিত সঞ্চারের দায় থেকেও তিনি মুক্ত, নতুন এই নৈরাজ্যের চরাচরে তিনি হয়ে উঠছেন একজন শব্দ-দাস কিংবা শব্দ-দানব। এবং শব্দের সাথে শব্দের এতসব বিয়ের আয়োজন অন্তে তাঁকে দেখাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী, সদা-স্মিতহাসির সফল ঘটকের মতো। কিন্তু তাতে এ জগতে কার ক্ষতি? এ-প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে কবিতার একমাত্র মার্গ-সাধনার পথ। অন্ততঃ নতুন লিখিয়েরা তাই ভেবে নিচ্ছে। এভাবে চলছে এক অচ্ছেদ্য দুষ্টু-চক্র।

       তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’-এর শুরুতেই যে প্রশ্ন করেছিলেন, সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে করা যায়, ‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’
             এবং আরো বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয়! ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’ এবং ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, এই দুষ্টু-চক্র কীভাবে সভ্যতার এই সময় গ্রন্থিতে প্রধান স্থান অধিকার করে নিতে চাইছে।
        শব্দে যদি ব্যুৎপত্তি থাকে,তা'হলে অকবির পক্ষেও সাজানো কবিতা নির্মাণ করা অসম্ভব নয়।
      কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়। কবিতায় কথাই সব। কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে। কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না। শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা। কেননা, শব্দই হল কবিতার মূলাধার।"
            মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিতার কথা বলতে গিয়ে একেই বলেছেন, ' শব্দে শব্দে বিবাহ বন্ধন।'
            বিবাহ বন্ধন সুন্দর হলে যেমন সংসার সুখের হয়ে ওঠে , তেমনি শব্দ ও শব্দের মিলন সুন্দর হলে, কবিতাও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।
           বস্তুত,শব্দ বাছাইয়ের পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়। মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় শক্তিশালী কবি জ্যান্ত করে তুলতে পারেন।
         যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে,
যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।

         কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার বলেছিলেন, "কবির ব্যুৎপত্তি বুদ্ধিতে নয়, উপলব্ধিতে।" এ'কথাও বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। কবিতায় অনুসন্ধিৎসু প্রাণ না থাকলে, শুধু শব্দের জাবর কাটলেই তা কবিতা হয়ে ওঠে না। এ'কথাটা অনেকেই বুঝতে পারেন না, সমস্যাটা সেখানেই।
    কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে, তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
       এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে  রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের কথা মনে পড়ছে।
         কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে। তার যুক্তি ছিল, শব্দ-বাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে, কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে, তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে, কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে।