রুবাইয়াত ও ওমর খৈয়াম (প্রথম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                    নির্দিষ্ট কোনো কালে, ওই কালের সমাজিক কোন মানুষ কবিতার জন্ম দেন। সেসব কবিতার অধিকাংশই হারিয়ে যায়। যেগুলো টিকে থাকে, সেগুলোর পরবর্তী সময়ে ভিন্ন রকম পাঠ তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে সেই পাঠ এমনই ভিন্ন হয় যে মূল কবিও সেগুলো চিনতে পারবেন কি না সন্দেহ হয়। ওমর খৈয়ামের কবিতা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ।

               ওমর খৈয়াম জন্মেছিলেন পারস্যের নিশাবুরে ১৮ই মে ১০৪৮ সালে, মৃত্যু ১১৩১ সালে। তার পরিচয় ছিল গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর দার্শনিক হিসেবে। তাঁর কবিতাগুলো পাঠ করা হতো দর্শনের বয়ান হিসেবে। খৈয়াম নিজেও সেই ভেবেই লিখে গেছেন। গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠে যখন ক্লান্তি আসত, তখন তিনি তাঁর বিখ্যাত চার লাইনের কবিতাগুলো লিখে গেছেন। দর্শনের পাঠ তৈরি করে গেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে। ভিটগেনস্টেইন একদম নির্দিষ্ট করেই বলে গিয়েছিলেন যে, 'কবিতা আসলে কেবল কবিতার ধরণেই লেখা উচিত।' পরে খৈয়ামের
জগৎজুড়ে তাঁর কবি হিসেবে খ্যাত আসে।   এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের অল্প কয়েক পৃষ্ঠার অনুবাদ ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার আগেও প্রাচ্যের জ্ঞানজগতে খৈয়াম ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। তবে সে  খৈয়াম তাঁর দর্শনের ভাবনার জন্য। তিনি দর্শনের ভাবনা লিখেছেন রুবাই ধরণে। একবচনে রুবাই, বহুবচনে রুবাইয়াত। মানে চৌপদী বা চতুষ্পদী। যে ভাবনাগুলো খৈয়ামের মনে দর্শন বা বিজ্ঞানের আওতায় তাৎক্ষণিক এসে ধরা দিত না, সেগুলোকেই তিনি কবিতায় লিখে রাখতেন।

             খৈয়াম কেবল রুবাই লিখলেন কেন? এর কারণ ছিল। ফারসি ভাষায় নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট করা কবিতার ধরণ আছে। যদি দীর্ঘ কাহিনি ধরণের কবিতা লিখতে চান, তাহলে 'মসনবি'। সেটা লিখে গেছেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি। প্রেম-বিরহের জন্য 'গজল'। কারও প্রশংসা করবেন, তবে 'কাসিদা'। আর যদি দর্শন নিয়ে লিখতে চান, তাহলে 'রুবাই'। রুবাইয়ের চলন এর জন্য খুব লাগসই। লেখা হবে চার লাইনে। প্রথম দুই লাইনে অন্ত্যমিল থাকবে। তৃতীয় লাইনের শেষে অন্ত্যমিল মুক্ত। আবার চতুর্থ লাইনে প্রথম দুই লাইনের মতো মিল থাকবে। প্রথম দুই লাইনে মূল বিষয়ের অবতারণা করা হবে। অন্তমিল সেই বিষয়ের ঐক্য ধারণ করবে। তৃতীয় লাইনে কবি বা দার্শনিক তাঁর সেই ভাবনা তুলে ধরবেন, যা তিনি পদ্ধতিগত আলোচনা বা চর্চায় উত্তর পাচ্ছেন না। চতুর্থ লাইনের অন্ত্যমিলের মধ্য দিয়ে তৃতীয় লাইনের সমস্যা নিয়ে কবির নিজের কথা থাকবে। আর তা প্রথম দুই লাইনে বলা আলোচনার সঙ্গে যোগ হবে। এর ইঙ্গিত বহন করবে চতুর্থ লাইনের অন্ত্যমিলে।