রুবাইয়াত ও ওমর খৈয়াম (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


              ফিটজেরাল্ড প্রথমে মাত্র ৭৫টি রুবাই নিয়ে একটা পুস্তিকা বের করলেন। সেটা লোকচক্ষুর আড়ালেই পড়ে ছিল বহুদিন। এদিকে প্রথম নজর পড়ল রাফায়েল ঘরাণার চিত্রকরদের। শুধু আগে থেকে সমাজের ঠিক করে দেওয়া মানদণ্ডে জগৎকে দেখার ক্ষেত্রে তাঁদের আপত্তি ছিল। বেচা-কেনার ব্রিটিশ সমাজে যা হৃদয়কে স্পর্শ করে যায় কিন্তু শিল্পে ধরা পড়ে না, তা তুলে আনতে চাইতেন রাফায়েল ঘরাণার শিল্পীরা। আর এর সজীবতা তুলে আনতে ব্যবহার করতেন উজ্জ্বল রং আর অসংখ্য ডিটেইল। ফিটজেরাল্ডের অনুবাদে 'ওমর খৈয়ামে' তাঁরা সরাসরি তাদের হৃদয়ের কথা শুনতে পেলেন। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে যা ঢাকা পড়ে ছিল চাপিয়ে দেওয়া নৈতিকতার বেড়াজালে।  
       ১৮৮০ সালের মধ্যে ফিটজেরাল্ডের
'ওমর খৈয়াম' অনুবাদের পর ইংরেজি ভাষাভাষী দুনিয়ায় খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় অসংখ্য 'ওমর খৈয়াম ক্লাব' গড়ে উঠল। সেখানকার সদস্যরা খৈয়ামের আদলে ইংরেজিতে রুবাই লেখা শুরু করলেন।
ফিটজেরাল্ড যে রুবাই অনুবাদ করছিলেন,
তা ছিল সেই সময়ের ইংরেজদের মেজাজের সঙ্গে মিল খায় তিনি বেছে নিয়েছেন সেইসব কবিতাগুলি , যেগুলো তাঁর স্বদেশী মানুষেরা সহজে তার অর্থ উপলব্ধি করতে পারে। সেই প্রয়োজনে তিনি কখনও একটা কবিতা ভেঙে একাধিক রুবাই তৈরি করেছেন। কখনও আবার একাধিক রুবাই জুড়ে দিয়ে একটা রুবাই তৈরি করেছেন। আর ফারসি কবিতায় ব্যবহৃত যে সব উপমা গভীর অর্থ বহন করে, সেগুলো হয়ে গেল তাতে সরাসরি সাধারণ অর্থে। সাকি, শরাব, শরাবখানা ইত্যাদি ফারসি রূপক আশ্রয় হারিয়ে অনাথ হয়ে গেল। ফলে ওমর খৈয়াম হয়ে গেলেন তাঁদের ভাষায় 'এপিকিউরিয়ান'। 'নগদ যা পাও হাত পেতে নাও'—এই হয়ে গেল তাদের দার্শনিক ওমর খৈয়ামের পরিচয়। চার্বাক দর্শনের মতো,'ঋণ করেও ঘি খাও।'

           কবিতার পাঠ সেই সময়কালের সমাজের রূপ অনুযায়ী বদলে যায়।
খৈয়ামের রুবাই প্রাচ্যে দর্শন হিসেবেই পড়া হয়েছে । আর তা কোনও নির্দিষ্ট দার্শনিক রূপ হিসেবে নয়, বরং জগৎ-সংসার নিয়ে অমীমাংসিত প্রশ্ন হিসেবে।

          যুদ্ধের ময়দানে দেখা গেল 'দেশসেবা' এই মহত্ত্বের খোলসের আড়ালে রয়ে গেছে অকৃত্রিম হিংস্রতা। এপিকিউরাসের পোশাক পরানো নগদ ভোগ করা আর দুনিয়া যে মায়ার খেলা মাত্র—এই কথা বলা ইংরেজরা ওমর খৈয়াম পেলেন আশ্রয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাংকারে তরুণ সৈনিকেরা পকেটে রাখতেন ওমর খৈয়ামের ফিটজেরাল্ডের করা রুবাইয়াৎ। এই ক্ষণই যে একমাত্র সত্য—এ কথা তাঁরা খৈয়ামের কাছ থেকে জেনে স্বস্তি পেতেন।

    এই প্রেক্ষাপট ধরে ইংরেজি অনুবাদের হাত ধরে ওমর খৈয়াম বাংলাতেও এলেন। প্রথমে কান্তিচন্দ্র ঘোষ , তারপরে নরেন্দ্র দেব ইংরেজি থেকে অসাধারণ বাংলা অনুবাদ করছেন। পরে মূল ফারসি থেকে কাজী নজরুল ইসলাম সুন্দর অনুবাদ করছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনুবাদ করছেন। তবে আমরা যে খৈয়ামকে চিনি,সে কবির চেহারার বড় অংশ সেই ফিটজেরাল্ডেরই আঁকায়। প্রাচ্যের দর্শনের নিষ্ঠাবান পাঠ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।