পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ - (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


’পশু শক্তির জয়ী হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না আমরা বাস করি সফল ন্যায় বিচারের যুগে’; ‘আবার পশুশক্তির কথা উচ্চারণ কোর না, নয়তো তুমি সোপর্দ হবে
গোপনে-গোপনে হেরে যাওয়া সব মতবাদ মেনে নাও
যার শক্তি আছে ,তারই আছে ঐতিহাসিক যুক্তিপ্রক্রিয়া..’

এভাবে দ্বৈত বাক-বিন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি একটা সিদ্ধান্ত দিতেও চেয়েছেন এক আত্মগত প্রশ্ন আর জবাবে।
  অনুবাদকের মিউশ প্রসংগে তার জীবন ভাষ্যে দেখা যায় যে প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সক্রিয় সদস্য, মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। স্বভাবতই তার কবিতায় তাঁর অঙ্গীকার মানবতার পক্ষেই থেকেছে, তিনি ভুলে যাননি তার পোল্যান্ডকে আবার বন্ধন ছিঁড়েও ফেলেননি তার প্রবাসী জীবনের সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ । অবশ্য যারা পার্টি সহিত্য বলতে রাজনৈতিক শ্লোগান বোঝেন. তাদের কথা আলাদা। অথচ মার্কস শিল্পীদের সম্পর্কে যথেষ্ট অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। তিনিও তাঁর কন্যারা শেকসপীয়র ভক্ত ছিলেন। ‘জোসেফ ভাইদেমেয়ারের’ কাছে লিখেছিলেন কবি তিনি যেমন মানুষই হোন না কেন, কিছু প্রশ্রয় ও প্রশংসার দাবী রাখে। .. হাইনেকে ভালোবেসে ফরাসী সরকারের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার কলঙ্ক থেকে তাকে রক্ষার চেষ্টাও করেছেন। ফলে এখানেই উপলব্ধির পার্থক্য। জে. অপ্রেসিয়ান ’স্বাধীনতা এবং শিল্পী’ বই-এ সিদ্ধান্ত আকারে জানিয়েছেন যে ’মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিতে শিল্পীর স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে জনগণের স্বার্থে জনগণের বৌদ্ধিক জীবনের সমৃদ্ধির জন্যে জনগণের সঙ্গে অগ্রসর হওয়া’।
তবুও শিল্প-সহিত্য প্রসংগে আলোচনার বিপরীতে আলোচনার শেষ নেই, বোধ করি শেষ হওয়াও উচিৎ নয়। কবি সহিত্যিকরা কোনো পার্টির সদস্য কিনা তা’ জরুরী নয়, যা প্রয়োজন তা হলো তিনি তার কাজে সৎ এবং সাহসী ছিলেন কিনা এবং সঠিকভাবে জীবনকে উপলব্ধি করে তার সৃষ্টিতে প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন কিনা, আর পাঠক তার রসাস্বাদনের মধ্য দিয়ে সুন্দরের অনুভবে একটি সত্যে পৌঁছাতে পারলেন কিনা। যেমন করে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, ’সত্যই সুন্দও, সুন্দরই সত্য’। এটা কীটসেরও বক্তব্য। আর সে সত্য হচ্ছে মানুষ, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর সুন্দর হলো তার চেতনা। তাই সত্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কবিকে পৌঁছাতে হয় বিস্তৃত চেতনায় । তার জন্য একজন কবির যেমন দরকার আবেগ তেমনি দরকার কল্পনা এবং বলবার মতো নিজস্ব ভাষা। তার আরো জানতে হয় নির্মাণ কৌশল আর উপযুক্ত সম্পাদনা। মিউশের কবিতায় এর সম মাত্রা ও পুষ্টির উপস্থিতি আছে।

বিশাল জীবন (১৯১১-২০০৪), অনেক কবিতা, অন্য লেখালেখি আর খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, পুরস্কার নিয়ে মিউশ কী করলেন? কীভাবে দাঁড় করালেন তিনি নিজেকে? কিংবা কী সেই ভাঙচুর যা তাঁকে চিহ্নিত করে স্বতন্ত্র হিসেবে? এই নিরিখে আমরা বলতে পারি, তা ছিল আসলে বের হয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা। তাঁর মন ও ইচ্ছাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। কবিতার যে প্রথাগত ধারণা এবং ফর্ম, এর ভেতর থেকে নিজেকে পৃথক করা। মিউশ বলেছেন, বিংশ শতাব্দীর ভয়ংকরতার মধ্যে তাঁর জন্ম, আধুনিক ইতিহাসের দুই বিশাল সর্বগ্রাসী অবস্থা, জাতীয় সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের মধ্যে তিনি বসবাস করেছেন। দেখেছিলেন ছিলেন দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধ। তা ছিল এক আত্মবাস্তবতা, সে-কারণে ফরাসি প্রতীকবাদী অনুসারীদের মতো তিনি বিশুদ্ধ কবিতার রাজ্যে পালাতে পারেননি। তিনি লিখেছেন অতীতকে নিয়ে, ট্র্যাজিক ও শ্লেষাত্মকভাবে। ‘আর্স পোয়েটিকা?’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘…that I’ve devised just one more means/ of praising Art with the help of irony।’ ( যে আমি বিদ্রুপের সাহায্যে শিল্পের প্রশংসা করার আরও একটি উপায় আবিষ্কার করেছি।') সাবজেক্টিভ আর্ট এবং অবজেক্টিভ আর্টের মধ্যে তিনি তাই শেষোক্তটির সমর্থক ছিলেন, এবং তিনি দাবিও করেছেন যে, তাঁর কাব্যের অনুশীলনই এর প্রমাণ দেবে। এসব কিছুও আপতিক নয়, আমাদের মাথায় রাখতে হবে, থিয়োডর আডোরনো, তাদেউশ রুজেভিচ বা জবিগনিয়েভ হেরবের্টসহ আরো অনেককে কবিতাকে অন্যভাবে দেখেছেন। তাই তিনি বলতে পারেন অনায়াসে : ‘শপথ করে বলছি, আমার কাছে কোনো শব্দের চাতুরী নেই/  মেঘ বা বৃক্ষ যে-ভাষায় কথা বলে, আমি তোমার সাথে সেই নৈঃশব্দ্যের ভাষায় কথা বলি।’ অর্থাৎ তিনি অনুসরক ছিলেন না আগেকার ধারার, বরং সময়ের ভাষা ও কবিতাকে লিখতে চেয়েছেন তিনি। শুদ্ধ কবিতার লালিতপালিত রূপ এবং সৌন্দর্যসৃষ্টি থেকে সরে এসে ভিন্ন-এক প্রায়াসে নিজেকে সৃষ্টিশীল রেখে ছিলেন তিনি, যা মানুষের অন্য-এক সংলগ্নতার কথা বলে। তিনি মনে করতেন, দৃশ্যমান বাস্তবতা কবিতার স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। এজন্যই তিনি বলেছেন, কবিতা তাঁর কাছে সাম্প্রতিক মানবিক দোলায়িত সময়ের এক অংশগ্রহণ। তবে এ-কথাও তিনি বলেছেন যে, তিনি কবির নিষ্ক্রিয়তা বা প্রতিক্রিয়াহীনতাতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যা কবিকে উপহার দেয় এক-একটি কবিতা যা বস্ত্তত উঠে আসে তাঁর গভীর চিন্তা বা ধ্যান থেকে। এসবই তাঁর কবিতায় স্থায়িত্ব নিয়েছে সফলভাবে। তাঁর কবিতার ভাষা ও স্বরসংগতি তাঁর নিজেরই মতো, যা অন্তর্গতের কণ্ঠকে চিনিয়ে দেয়। তিনি বলতেও চান আত্মকথন বা স্বীকারৌক্তিক ধরণে ও উচ্চারণে এবং এই প্রবণতা তাঁর সমগ্র জীবনের শর্তেই যেন প্রকাশিত।
        মিউশ, যদিও পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেননি, তবু তিনি নিজেকে পোলিশ কবি বলেই মনে করতেন, কারণ তিনি নেটিভ মাতৃভাষা পোল ভাষাতেই  লিখতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বলেওছেন যে, ভাষাই তাঁর স্বদেশ। পোল্যান্ডে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি, থাকেনওনি বহু বছর। তিনি জন্মগ্রহণ করেন লিথুয়ানিয়ায়, ১৯১১ সালে, তাঁর কৃষক পিতামহের ছোটো তালুকে। মিউশ এই গরীব লিথুয়ানিয়াকে আখ্যায়িত করেছেন ‘কবিতা এবং পুরাণের দেশ’ বলে। 'নেটিভ রেল্ম' গ্রন্থে তিনি আরো বলেছেন, যখন ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় রাজ্যের পতন আর উত্থান হচ্ছিল আকছার, সে-সময়ে লিথুয়ানিয়া ছিল কুমারী অরণ্যে ছাওয়া এক অঞ্চল যেখানে উপকূলে মাঝেমধ্যে ভাইকিংদের জাহাজ ভেড়া ছাড়া আর কিছুই ঘটত না। তিনি বলেছেন, ‘মানচিত্রের জ্ঞানসীমানার বাইরে এটা ছিল বাস্তব অপেক্ষা অধিক পৌরাণিক।’
           মিউশের শৈশব হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে টালমাটাল। তাঁর পিতা, আলেকজান্ডার ছিলেন সড়ক প্রকৌশলী এবং যুদ্ধের সময় তাঁকে জারের বাহিনীতে কাজ করতে হয়েছিল। এ-সময় রাশিয়ার যুদ্ধ-এলাকায় সেতু নির্মাণের কাজে তাঁকে নিয়োজিত থাকতে হয়েছিল, আর মিউশ ও তাঁর মাও তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে ছিলেন। এই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে মিউশ বলেছেন, ‘আমাদের ঘর ছিল প্রায় সময়ই এক ঢাকা ওয়াগন।’ ১৯১৮ সালে তাঁদের পরিবার লিথুয়ানিয়ায় ফিরে আসে। এখানে তাঁর শৈশব ছিল প্রশান্তময় আর এখানেই অতঃপর রাজধানী ভিলনিয়াসে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি আট বছর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং তা ছিল অনেকটা ক্যাথেলিক গোছের শিক্ষা। এ-বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিনই শুরু হতো প্রার্থনা দিয়ে আর সেখানে গীত হতো সেই গান : ‘যখন ভোরের আলোরা জেগে ওঠে।’ ক্যাথেলিক মতবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ক্যাথেলিক বিশ্বাস বা মতবাদ খুবই শক্ত মতবাদ, কারণ তা যেন সত্যিই ধরে  রেখেছে কতিপয় ভূতাত্ত্বিক স্তরপরম্পরা। ১৯৩৩ সালে ২১ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ আ পোয়েম অন ফ্রোজেন টাইম এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থ্রি উইন্টার ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। তিরিশের দশকে তিনি নিজেকে যুক্ত রাখেন ক্যাটাসট্রোফিস্ট স্কুলের কবিদের সঙ্গে। ক্যাটাসট্রোফিজমের মানে হলো, চূড়ান্ত মূল্যবোধের সমূলে ধ্বংসসাধন, বিশেষত সেই মূল্যবোধ যা একটি এগিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক পদ্ধতির জন্য প্রয়োজনীয়। তবে তা কিছু নির্দিষ্ট মূল্যবোধকে, কিছু ঐতিহাসিক রূপায়ণকে দূর করতে চায় বলে দাবি করেছিল, মোটেই  মানবতাকে নয়। মিউশ এখানেই আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং এরপর পারিতে বৃত্তি নিয়ে এক বছর কাটান। সাহিত্য নিয়ে না পড়ে আইন নিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি তিনি কী হতে চান তা আগেই প্রকাশিত হয়ে যেত তাহলে নিজের কাছেই পরাজিত হয়ে যেতেন যেন। তবে বৃত্তিটা  ছিল আইন নয়, বরং সাহিত্যের ওপর রাষ্ট্রীয় বৃত্তি। সেখানে তিনি তাঁর দূরবর্তী সম্পর্কের ভাই অস্কার মিউশের দেখা পান, যিনি ছিলেন ফরাসি কবি, এবং মিউশ তাঁর দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন সে-সময়। সে-সময়ের তাঁর নিজ চিন্তা-বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সকল তরুণ কবির মতো আমিও বিশ্বাস করতাম যে, সমসাময়িক শিল্পে কিছু গোপন জায়গা আছে, আর আছে এক সুতো যা একজনকে গোলকধাঁধার ভেতরে নিয়ে যায়।’ অস্কার মিউশ তাঁর একটি কবিতা বিখ্যাত এক রিভিয়্যু পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে মিউশ স্বীকারও করেছেন, তাঁর ওপর অস্কার মিউশের প্রভাব ছিল তুমুল, বিশেষত শৈলীর দিক থেকে। প্যারিস রিভিয়্যুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ-প্রভাবের বিষয়ে তিনি জানিয়েছিলেন : ‘বস্ত্তত আইনস্টাইনেরও আগে, তিনি স্বতঃলব্ধভাবে, আপেক্ষিকতার এক মহাবিশ্বতত্ত্বকে অনুধাবন করতেন – এক মুহূর্ত যখন সেখানে কোনো স্থান নেই, পদার্থ নেই, কাল নেই; এই তিনটিই, তাঁর কল্পনাশক্তিতে, এক গতিময়তার সাথে সম্পর্কিত ছিল।’