পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ - (সপ্তম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                    কবিতা লেখা এক অনিঃশেষ যাত্রা এবং প্রতিবারই কবি মনে করেন, নিজেকে তিনি নিঃশেষ করে দেবেন পরবর্তী লেখায়; কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত অনিঃশেষিতই থেকে যায়। একটি কবিতা, ‘স্পাইডারে’, তিনি রূপকের আবরণে এও বলেন যে, কবিতা হলো সময়ের সীমান্ত রেখার ওপারে পাড়ি দেওয়ার জন্য অতি ক্ষুদ্র এক নৌকা নির্মাণ করা। পেরোনো বা পাড়ি দেওয়া, এটা হলো সেই গুপ্ত ও সুপ্ত সন্ধান যা চলে নিরন্তর কবির ভেতরে। অর্থাৎ অধরা কবিতার প্রতি অন্ধভাবে ছুটে চলা। নিজেকে তিনি হারমেটিক কবি বলেছেন। তিনি মনে করতেন, তিনি লেখেন সেই আদর্শ ব্যক্তির জন্য যার আছে এক অপর সত্তা। নিজেকে তিনি অধিক প্রবেশযোগ্য মনে করতেন না। তাঁর মাপকাঠি ছিল, কবিতা ঠিক যথার্থ ও প্রয়োজনীয় হয় কি না। গন্ডগোল ও নঞর্থকতার বিরুদ্ধে বাস্তবতাকে তিনি কতটুকু আঙ্গিকায়িত করতে পারলেন, তা-ই ছিল তাঁর ভাবনার জায়গা। তিনি বলেছেন, তাঁর কবিতা সবসময়ই সুপরিসর ফর্মের জন্য এক অন্বেষণ। মিউশ মনে করতেন, বস্ত্তপৃথিবীকে ব্যবচ্ছেদ না করে বরং অনুভব বা ধ্যান করা উত্তম। বস্ত্তর প্রতি এই নিরাসক্ত অভিপ্রায় ওলন্দাজ স্টিল লাইফে পাওয়া যায় এবং শোফেনহাউয়ার একেই বিবেচনা করেছেন শিল্পের সর্বোচ্চ ফর্ম। মিউশও বলেছেন, শিল্পের ভালো একটি সংজ্ঞার্থ হলো এই নিরাসক্ত ধ্যান। দ্য উইটনেস অব পোয়েট্রিতে কবিতাকে তিনি বলেছেন, ‘বাস্তবের সংরাগিত পশ্চাদ্ধাবন’ যা শেষাবধি দূরাবগাহই থেকে যায়। এর সঙ্গে মিলে যায় ভার্জিনিয়া উল্ফের কথা, শিল্প হলো বুনোহাঁসের পশ্চাদ্ধাবন। পুঁজিবাদী পশ্চিম আর সাম্যবাদী পুবের কবিতার ভিন্নতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, পশ্চিমের কবিতা বিবিক্ত, তা অন্তর্বীক্ষণের অন্তর্দাহে ঠাসা; অন্যদিকে পুবের কবিতা তা নয় মোটেই, কারণ কবিকে সেখানে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, তৃপ্ত করতে হয় একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাধরকে। তিনি শিল্পের জন্য শিল্প – এই গোষ্ঠীর লেখকদের সমালোচনা করেছেন। তবে কবি হিসেবে তিনি শেষাবধি বোধহয় তৃপ্তই ছিলেন। ‘রিপোর্ট’ কবিতার প্রথমেই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি জানান দেন, ‘হে মহান, তোমার ইচ্ছায় আমি কবি হয়ে জন্মেছি আর এখন আমার সময় রিপোর্ট দাখিল করার।’ দ্য হিস্টোরি অব পোলিশ লিটারেচারে তিনি বলেছেন, কবিতা লেখার কাজ হলো এক বিশ্বাসের কাজ। আমরা জানি তাঁর ক্যাথেলিক বাল্যকাল। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য, সমসাময়িক সমাজের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো নৈতিক ভিত্তির অভাব। দ্য ল্যান্ড অব উলরোতে তিনি বলেছেন, আধুনিক মানুষের কেবল আছে মাথার ওপরে নক্ষত্রময় আকাশ আর ভেতরে নৈতিক আইনহীনতা। নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিয়্যুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তিনি সেই উত্তর খোঁজ করছেন, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের অভ্যন্তরীণ ভাঙন থেকে উঠে আসে। সমালোচকেরাও বলেছেন, নৈতিকতায়, নান্দনিকতায়, মূল্যবোধে রোপিত সাহিত্যই তাঁর অন্বিষ্ট। এভাবেই নষ্ট পৃথিবীতে নষ্ট-হয়ে-যাওয়া আধ্যাত্মিকতাকে জাগাতে চাইলেন মিউশ। এর সঙ্গে সহজেই আমরা মিল খুঁজে পাই এলিয়টের। এলিয়টও রীতিমতো দীক্ষা নিয়েছিলেন ক্যাথেলিসিজমে, লিখেছিলেন দ্য আইডিয়া অব অ্যা ক্রিশ্চিয়ান সোসাইটির মতো বই। মানবতাবাদের পরিবর্তে তিনি ক্যাথেলিক ধর্মমতেই বিশ্বাস স্থাপন করে বসে থাকেন। প্রথম জীবনে ঈষৎ হেলে-থাকা নাস্তিক-মার্কসবাদী এবং শেষমেশ রোমান ক্যাথেলিকবাদে আত্মসমর্পণকারী ও আশ্রয়ী চেসোয়াভ মিউশ কি এই ‘বাস্তব’ বা ‘সত্য’ বলতে ঈশ্বরকেই বুঝিয়েছেন? প্রকৃতপক্ষে তা-ই : Religion used to be the opium of the people. To those suffering humiliation, pain, illness, and opium of the people is the belief in nothingness after death, the huge solace, the huge comfort of thinking that for our betrayals, our greed, our cowardice, our murders, we are not going to be judged serfdom, religion promised the reward of an afterlife. But now, we are witnessing a transformation, a true.
(ধর্ম ছিল মানুষের আফিম।যারা অপমান, যন্ত্রণা, অসুস্থতা এবং মানুষের আফিম ভোগ করছে তাদের কাছে মৃত্যুর পর শূন্যতায় বিশ্বাস, বিশাল সান্ত্বনা, আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আমাদের লোভ, আমাদের কাপুরুষতা, আমাদের হত্যার জন্য আমরা যাচ্ছি না। দাসত্ব বিচার করা, ধর্ম একটি পুরস্কার প্রতিশ্রুতি পরকাল
শেষ জীবন
ভবিষ্যৎ জীবন
কিন্তু এখন, আমরা একটি রূপান্তর প্রত্যক্ষ করছি, একটি সত্য৷)
                       অনেকে তাঁকে একাধারে সংশয়বাদী আর সাধু বলে অভিহিত করেছেন। ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট, ৯৩ বছর বয়সে কাকাওতে তিনি মারা যান। হাজার হাজার মানুষ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল। পবিত্র ঘটনা হই-হুল্লোড়ে পরিণত হয়েছিল শেষাবধি। কয়েক দিন আগে, উগ্র-জাতীয়তাবাদী ক্যাথেলিকরা অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ করে তাদের প্রতিবাদ জানাবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। কারণ তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার জন্য এই নোবেল লরিয়েট না ছিলেন যথেষ্ট পোলিশ, না ছিলেন যথেষ্ট ক্যাথেলিক। শুনলে মিউশ নিঃসন্দেহে আনন্দ পেতেন কারণ একদা তিনিই বলেছিলেন যে, ‘একজন মানুষের অনিবার্য দ্বন্দ্বগুলোই তার শুদ্ধিস্থল।’ বলা সংগত যে, তাঁর মধ্যে এই দ্বৈততা ছিল প্রণিধানযোগ্য। তিনি ক্যাথেলিক, কমিউনিস্ট, নস্টিক, মানিকীয়পন্থী, সংশয়বাদী যিনি বলেছিলেন, ‘আমার সব বৌদ্ধিক তাড়নাই ধর্মীয়।’ সমালোচকেরা বলেছেন, মিউশ বাম বা ডান, কারো কাছেই বন্ধুত্বময় ছিলেন না। দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড লেখার পরও যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন কমিউনিস্ট সংযুক্তির কারণে তাঁকে সন্দেহ করত। ইউরোপীয় বামপন্থীরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক ভাবত। পাবলো নেরুদা এক লেখায় ‘পালিয়ে যাওয়া মানুষ হিসেবে’ তাঁকে ভৎর্সনা করেছিলেন।

                    তবে যা-ই হোক, মিউশ বিংশ শতাব্দীর এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যেমনটা তাঁর সম্পর্কে বলেছেন আরেক দেশত্যাগী কবি জোসেফ ব্রদস্কি : ‘আমাদের সময়ের অন্যতম এক মহৎ কবি, সম্ভবত মহত্তম।’

                   ‘আমি মনে করি না যে, নোবেল পুরস্কার আমাকে বা আমার কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে’।