পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ - (পঞ্চম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


১৯৬১ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে, মিউশ আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং বার্কলিস্থ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লাভিক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে অত্যল্প একটি বিভাগের একজন শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও অচিরেই দস্তয়েভস্কি-বিষয়ক কোর্সগুলোর জন্য তাঁর প্রভূত নামধাম হয়ে যায় এবং সেখানে তিনি অনুবাদ, বিশেষত জবিগ্নিয়েভ হেরবের্টের কবিতার অনুবাদ করেন। আমেরিকায়  আত্মজৈবনিক লেখা ন্যাটিভ  রেল্ম : আ সার্চ ফর সেলফ ডেফিনেশন এবং ভিশনস ফ্রম সান ফ্রান্সিসকো বে প্রকাশিত হয়। এই বইগুলোতে মিউশ তাঁর দেশ পোল্যান্ডের সঙ্গে পশ্চিমকে তুলনা করে মতামত তুলে ধরেন। ১৯৭০ সালে তিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব পান। ১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত তাঁর নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৮ সালে তাঁর সংকলন বেলস ইন উইন্টার প্রকাশিত হয়, আর ১৯৮০ সালে তিনি পেয়ে যান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। পোল সাহিত্যিকদের মধ্যে নোবেলপ্রাপ্তিতে তিনি হলেন পঞ্চম। ১৯৮১ সালে ত্রিশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তিনি পোল্যান্ড ভ্রমণ করেন আর ১৯৯২ সালে বায়ান্ন বছর পর তাঁর নিজ দেশ লিথুয়ানিয়ায় পুনরায় যান। বাহান্ন বছরের মধ্যে আবার লিথুয়ানিয়ায় যাওয়া সম্পর্কে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, তা ছিল এক ভ্রাম্যমাণ অভিজ্ঞতা। সেখানে তাঁকে দেশের ছেলের মতোই বরণ করে নেওয়া হয়, সাম্মানিক ডিগ্রিও দেওয়া হয়। যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেও তিনি যান কিন্তু সেখানে তখন আর কোনো ঘরবাড়ি অবশিষ্ট ছিল না, ছিল না সেই মানুষগুলোও। ৫২ বছর পর লিথুয়ানিয়ায় গমন উপলক্ষে তিনি লেখেন - কবিতা

‘লিথুয়ানিয়া, বায়ান্ন বছর পর’; তিনি লেখেন :

‘আমরা ধন্যবাদ দিই নিজেদের আর পূর্বপুরুষদের নামগুলোকে
ওক আর তাদের এবড়োখেবড়ো বাকলগুলোর জন্য
পাইন, আর তাদের সূর্য-ঝলসিত গুঁড়িগুলোর জন্য
বসন্তকালের বার্চের কুঞ্জবনের পরিষ্কার সবুজ মেঘগুলোর জন্য
আর সেই পপলারের  হেমন্তের খাঁ খাঁ প্রান্তরের পিলসুজের জন্য।’
লিথুয়ানিয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তা ছিল এমন-একটা জায়গা যেখানে তখন ছিল না কোনো রেডিও, টেলিভিশন বা কোনো ছায়াছবি, এরকম একটা ইউরোপীয় প্রাদেশিক স্থানেই তাঁর শৈশবে বেড়ে-ওঠে। এত কিছুর ঘাটতির পরও তিনি বলেছেন, সেখানে ছিল বইয়ের প্রাচুর্য, বিশেষত তাঁর পিতামহের পাঠাগারটি তাঁকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যেখানে ঠাসা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর সব বিখ্যাত বই। পরে যখন তিনি ভিলনিয়াসে বাস করতে লাগলেন, তখন তিনি সিনেমা দেখা শুরু করেন। ভিলনিয়াস হলো এমন এক শহর যা বারেবারে প্রত্যর্পিত হয়েছে তাঁর লেখায়। তিনি বারবার এই শহরের কথা বলেছেন সাহিত্যে। মিউশ যখন পশ্চিমে তখনো তিনি পশ্চিমা পাঠকদের কাছে এ দুই শহরকে পরিচিত করিয়ে দিতে চাইতেন।
        যদিও ১৯৬১ সাল থেকে তিনি আমেরিকায় বসবাস করেছেন তবু সেখানে তাঁর কবিতা কমই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পোল্যান্ডে তিনি ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও কমিউনিস্ট শাসনের সময় একজন দেশত্যাগী হিসেবে তাঁর লেখা প্রচারিত হতো না রাষ্ট্রীয়ভাবে। এর কারণেই তিনি ভেতরে ভেতরে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন – তাঁর বইয়ের অনেক গোপন বা আন্ডারগ্রাউন্ড সংস্করণ বের হতো, প্রচারিত হতো তা ততোধিক গোপনে। কিন্তু ১৯৮০ সালে নোবেল পাওয়ার পর কমিউনিস্ট সরকার অনেকটা বাধ্য হলো তাঁর বইয়ের প্রকাশনা করতে। তাঁর কবিতার এক সংকলন বের হলো, যা সরকারিভাবে বিক্রি হয়ে গেল দুই লাখ কপি। পোল্যান্ডে মিউশের জনপ্রিয়তার আরেক প্রমাণ হলো, কমিউনিস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত কমরেডদের স্মরণে যখন পোলিশ শ্রমজীবীরা এক মনুমেন্টের উদ্বোধন করল, সেখানে উৎকীর্ণ করা হলো বাইবেল আর মিউশের এক কবিতা থেকে।