পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ - (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


’এইতো পোল্যান্ডের সব অগভীর নদী-ধোঁয়া উপত্যকা।
আর এক বিশাল সেতু
শাদা কুয়াশায় চ’লে যাচ্ছে।
এই যে ভাঙাচোরা শহর,
আর হাওয়া ছিটিয়ে দেয় তোমার কবরের ওপর গাং-চিলের চীৎকার,
যখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি’।

     গাংচিল নদী-নির্ভর পাখি, নদীর মাছ খেয়ে সে বাঁচে, তার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ-তীব্র, সচকিত করে চার-পাশ এবং কখনও কখনও ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে ’আর ভাঙাচোরা শহর’ উপমা হিসেবে জীবন ও জীবিকার বিপর্যস্ততাকে তুলে আনছে সেই তুমির ক্ষেত্রে যাকে কবি বাঁচাতে পারেননি। শুধু তা’ কবি নয় আরো অনেককে, অনেক সহযোদ্ধা যাঁরা বাঁচেনি কিংবা যারা বেঁচে গেছেন, আকুতিটা নিজের মধ্য থেকে বৃহত্তের দিকে সম্প্রসারিত… ‘এবং আমি তোমার সঙ্গে কথা বলি নিশ্চেতনা থেকে’ … এই ধরণের উচ্চারণ আমাদেরকে অন্যরকম ব্যঞ্জনাময় অনুস্বরের মধ্যে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি এরকম সরল ব্যাঞ্জনাধর্মী পঙক্তির বিস্তার আমরা লক্ষ্য করতে পারি। ’কোন নাগরিকের গান’ কবিতায় ’আমি দেখেছি দেশগুলোর পতন আর কত জাতির নরকবাস, রাজা ও সম্রাটদের পলায়ন, স্বৈরাচারীদের ক্ষমতা।’ ’কোন নাগরিকের গান’ কিংবা ’কাফে’ কবিতাটির - ’কাফের সেই টেবিলটায় যারা বসতো
যেখানে শীতের দুপুুরে জানলার কাঁচে ঝলসে উঠতো বাগানের তুহিন
শুধু অমিই বেঁচে আছি একা’

একদম সাদা-মাটা বিবৃতি কিন্তু ব্যঞ্জনাময়, দুপুর আছে, শীতও আছে কাফের সেই টেবিলটা ও আছে, কিন্তু আরও যারা ছিলো একদিন এবং একদিন যারা এমন শীতের দুপুরে এখানে থাকবে বসবে বলে আশা করা গেছে তারা আর নেই। এমন ’নেই হয়ে যাওয়ার’ স্মৃতিগুলো যা চেতনে অবচেতনে জাগ্রত দিনের মতো
’অবিশ্বাস ভরে আমি ছুঁই তুহিন মর্মর
অবিশ্বাস ভরে আমি ছুঁই আমার নিজের হাত’– এক দ্বান্দ্বিক সংকোচন ও সম্প্রসারণ পাঠককে মুগ্ধতা দেয় ।
          ১৯৪৪ সালে লেখা এই কবিতাটি পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবে পোল্যান্ডের মানুষের প্রতিরোধ যুদ্ধ, যুদ্ধের ভয়াবহতা আর সেই যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া তাজা প্রাণগুলোকে,
’কারণ আমি-তো এখনও জানি না মানুষের হাতে ম’রে যওয়াটা সত্যি কী, ওরা জানে ওরা জানে তার সব’।
    এই কবিতাটা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষদেরকেও যেন একই ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়, একই ভাবে বলা যায় সবই আছে ওরা নেই, অথচ ওরাই জানে মানুষের হাতে মরে যাওয়ার সত্যিটা, ওরা জানে তার সব, শুধু এদিকের এরা আজও জানে না, তাই এতো বিপত্তি ।
           আধুনিক কালের মনীষীরা সারা পৃথিবীকে তাঁদের সৃজন ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত করেছেন, তাঁদের সর্বাগ্রগণ্যদেও মধ্যে আছেন মার্কস, ডারউইন আর ফ্রয়েড । বলা যেতে পারে তাঁদের জ্ঞানালোক দ্বারা তারা মানব জীবন বুঝতে জানতে এবং তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে বিপুল অবদান রেখে গেছেন, যা আজো সারা পৃথিবীকে ভাবিয়ে চলছে, আলোড়িত করছে। ্ডারউইনের আবিষ্কার যুগ-যুগ ধরে প্রগতিরুদ্ধ মানুষদের জানতে চিনতে বুঝতে শিখিয়েছে জীবন বিকাশের নিয়মাবলী, আর মার্কসের সমাজত্ত্ব, দর্শন সমাজ রাষ্ট্র, রাজনীতি অর্থনীতি যে গতি দিয়েছে তা’ শুধু মাত্র রাষ্ট্র-রাষ্ট্রক্ষমতার মধ্যেই সীমিত থাকেনি, বরং জীবনকে আমূল বদলাতে প্রয়োজনীয় বহু বিষয়ে মানুষকে বিপুল প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে । শিল্প-সহিত্য সহ নানা সৃজনশীল কাজে তার প্রভাব পড়েছে অপরিসীম । ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব ’ ঈশ্বর অপরিবর্তনীয়, ধ্রুব বিশ্বাসের প্রতীক’ – মানুষের এই সনাতন মূল্যবোধে প্রচন্ড আঘাত হানলো। তার আবিষ্কৃত মনস্তত্ত্ব বলছে, মানুষের চেতনা সংহত কোন পদার্থ নয়, চেতনার আলো দূরবিস্তৃত এক অতল অন্ধকারে, যা নিয়ন্ত্রিত হয় চেতনার ক্রিয়া-কলাপে । ফ্রয়েড তত্ত্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানেই যখন ভারতবর্ষে পৌঁছালো তখন তা’ এখানকার শিল্পী-সাহিত্যিকদের মানসিক জগতেও আলোড়ন তুলেছিলো। রবীন্দ্রনাথের সাথে ফ্রয়েডের সাক্ষাত হয়েছিলো ১৯২৬ সালে ২৫শে অক্টোবর, ভিয়েনায়। ফ্রয়েড-এর তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন, জীবনের শেষের দিকে আনন্দরূপের জয়গান করতে করতে মনের আদিমতম রূপকেও তিনি অস্বীকার করতে পারেননি,
‘অচেতন তোমার অঙ্গুলি
অস্পষ্ট শিল্পের মায়া বুনিয়া চলিছে
আদি মহার্ণব গর্ভ হতে
অকস্মাৎ ফুলে ফুলে উঠিতেছে
প্রকাশে স্বপ্নের পিঞ্জর
বিকালাঙ্গ,অসম্পূর্ণ ’
’তুমি মোরে দিয়েছ কামনা.
অন্ধকার অমারাত্রি সম’
বা
‘শত শত শুকরের চিৎকার সেখানে
শত শত শুকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর’’
এমনি অনেক পঙক্তি রচিত হয়েছে বাংলা কবিতায়। ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব খুব বেশী বিস্তার পেয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়, এ জন্যে কোন কোন সমালোচক তা’কে নিশ্চেতনার কবি বলেও অভিহিত করেছেন । যদিও আমার মনে হয় কখনও কোন কবিকে বিশেষ কোন অভিধায় অভিহিত করা যুক্তি-যুক্ত নয়। কবি যে কবি, এটাই তার সার্থক পরিচয় । ফ্রয়েড ’চেতন ও অবচেতনের’ নিচে আর একটি স্তরের কল্পনা করেছেন যাকে বলা হয়েছে প্রাগ-চেতনা; এতে থাকে সেই সব অভিজ্ঞতা যা এক সময় মানুষ উপভোগ করেছে। প্রাগ চেতনার মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে থাকে মনের প্রহরী, ফ্রয়েড যাকে বলেছেন ‘সুপার ইগো’। মনের অনেক কামনা বাসনা যা সমাজ কাঠামোয় প্রকাশ অসংগত ’সুপার ইগো’ তা’ প্রকাশে অনুমতি দেয় না । তার এ তত্ত্বের বিপরীত মতও আছে এবং বিধান নিয়েও নানা সময়ের আলোচনা আছে। ইয়ঙ এবং পাভলভ প্রমূখরা ভিন্ন কিছু মতামত এবং বিধানের কথাও বলেছেন। সে প্রসংগ এখানে আলোচ্যে বিষয় নয়, তবে কাব্যে শিল্পে ফ্রয়েডের এই আবিষ্কার শিল্প শৈলী, চিত্রকল্প বিষয়বস্তু ইত্যাদিতে প্রয়োগ পেয়ে সৃষ্টিকে যে আরো গভীর, ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে এবং গতানুগতিকতাকে ভেঙে শিল্পী-কবি-লেখক সৃজনশীল মানুষকে এবং তার পাঠককে নতুনতর নির্মাণ শৈলীর ভুবনে প্রবেশ করতে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মিউশের অনেক কবিতায় মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োগ সার্থকভাবে আছে ।
       'কোন দেশকে ভালোবেসো না :
দেশগুলো চট ক’রে উধাও হ’য়ে যায়
কোন শহরকে ভালোবেসো না ;
শহরগুলো সব চট করে আবর্জনার স্তূপ হ’য়ে পড়ে..
অতীতের সব দিঘিগুলোর দিকে তাকিয়ো না…এমন এক মুখ যা তুমি কখনও প্রত্যাশা করোনি’।

মিউশের কবিতাগুলোর ভিতরে লক্ষ্য করলে আমরা চেতন-অবচেতন আর অচেতন-এর নানা উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারি । নির্বাসিত জীবনে তিনি আমেরিকায় আর জন্মসূত্রে তিনি পোলিশ, পোল্যান্ডের ভূমি, বাতাস, মানুষ প্রান্তর তার চেতনা জুড়ে থাকলেও বর্তমান সময়, অবস্থা-অবস্থান-পারিপার্শিকতায় তার অনেক ইচ্ছে, কর্ম, সাধনা নানা রূপ বিরূপতায় ধূসর হয়ে উঠেছে। ওই সব দিনগুলোর স্মৃতি হারিয়েও যায়নি , আবার প্রকাশ পারঙ্গমও নয়, তাই তারা নানা প্রতীকী ব্যাঞ্জনায় উঠে আসছে এই ভাবে।