পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ - (চতুর্থ পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


             ভিলনিয়াসে সোভিয়েত শাসনের সময় মিউশ তাঁর যৌবনের শহর থেকে পালিয়ে নাৎসি-অধিকৃত ওয়ারশতে চলে যান। সেখানে তিনি সমাজতান্ত্রিক প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেন। সে-সময়ে তাঁর নাৎসিবিরোধী কবিতা সংকলন অজেয় কবিতা আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি লেখেন ‘জগৎ’ এবং ‘ভয়েসেস অব পুয়োর পিপল’। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধ শুরু হলে পোল্যান্ড নাৎসি জার্মানির ও রাশিয়ার অধিকারে চলে যায়, মিউশ প্রতিরোধ আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। এ-সময়ে কবিতাবলি নামে এক সংকলন জে. সিরাক ছদ্মনামে প্রকাশ করেন তিনি। ওয়ারশর পতনের পর তিনি ক্রাকাওয়ের বাইরে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করেন। ১৯৪৫ সালে স্টেট পাবলিশিং হাউস তাঁর কবিতা সংকলন রেসকিয়্যু প্রকাশ করে। ওয়ারশতে প্রতিরোধ কার্যক্রমের সময়টাতে  নিজের কবিতাতে তাঁর প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, কবি হিসেবে তখন তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, কবিতা আগের মতো আর পৃথিবীকে  মেলে ধরতে পারে না, আর এর জন্য দরকার ভিন্ন পথের। অর্থাৎ কবিতা লিখলেও তাকে হতে হবে অন্যরকম। এখানে অবস্থানকালীন টি.এস. এলিয়টের কবিতারও অনুবাদ করেন তিনি। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডকে তাঁর মনে হয়েছিল বিপর্যয়কর এবং গভীরভাবে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপাত্মক।
         যুদ্ধের পর মিউশের জীবনে অন্য পরিবর্তন আসে।  মিউশ পোলিশ কমিউনিস্ট সরকারের কালচারাল অ্যাটাশে হিসেবে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে কাজ করেছিলেন এক বছরের মতো। যখন তাঁকে পোল্যান্ডে ফিরে আসার জন্য বলা হয়, তখন তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৫১ সালে তিনি পোলিশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। এই ফিরে না-যাওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি জানতেন তাঁর দেশ এক সাম্রাজ্যের প্রদেশ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, নতুন সাম্যবাদী বিশ্বাসকে তিনি অস্বীকার করেছেন কারণ মিথ্যাই ছিল তার প্রধান অনুজ্ঞা, আর সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বস্ত্তত ছিল মিথ্যারই আরেক নাম। কমিউনিস্ট শাসনে তাঁর মুখোমুখিতা ও অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেন তাঁর দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড বইয়ে। পাশ্চাত্যে এটিকে সর্বগ্রাসী মানসিকতার এক মৌলিক ও অসাধারণ গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সে-সময়ে পারি থেকে তাঁর কবিতা সংকলনও প্রকাশিত হয়। পারিতে তিনি অনুবাদক ও ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে কাজ করেন। দশ বছরের ফ্রান্স-অবস্থান খুব সুখকর হয়নি বিশেষত সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিচারে। এই সময়ে তাঁর দুটি উপন্যাস – সিজার অব পাওয়ার, দ্য ইসা ভ্যালি আর বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড প্রকাশিত হয়। দ্য সিজার অব পাওয়ার হলো তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস। ক্ষমতা যখন বদলায় তখন কীভাবে বাঁচতে হয়, এটিই এই উপন্যাসের ভাব। প্রকৃতপক্ষে দ্য সিজার অব পাওয়ার আর দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ডের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। দুটোতেই বর্ণনাতীত যন্ত্রণা এবং পোল্যান্ডের দুর্ভাগ্যের অবস্থাকে দেখানো হয়েছে। এই বইয়ে মিউশ আহবান করেছেন পশ্চিমকে পূর্ব ইয়োরোপকে ঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য। দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ডে তিনি দেখিয়েছেন, সর্বগ্রাসী শাসন কালে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক স্খলন। এ-গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, যখনই তিনি জীবনের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকেন, ঠিক তখনই একটি ইমেজ তাঁর কাছে ফিরে ফিরে আসে : ‘চোখের সামনে দেখলাম, সর্বদা একই তরুণী ইহুদি বালিকা। সম্ভবত সে ছিল বিশ বছর বয়সী। তার শরীর ছিল পূর্ণ, চমকপ্রদ, উল্লাসময়। সে রাস্তায় দৌড়াচ্ছিল, তার হাত ওপরে তোলা, বুক সামনের দিকে। সে তীব্রভাবে চিৎকার করে উঠল, ‘না! না! না!’ মৃত্যুর অনিবার্যতা তার বোধের বাইরে – যে-অনিবার্যতা বাইরে থেকে এসেছে, যা তার অপ্রস্ত্তত শরীরের সাথে স্বাভাবিক নয়। চিৎকারের মধ্যেই এসএস গার্ডের স্বয়ংক্রিয় পিস্তলের গুলি তাকে বিদ্ধ করল।’ ১৯৪১-৪৩, এই সময়ে ওয়ারশ গেটোতে প্রায় চার লাখ ইহুদি ধ্বংস হয়। দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ডে মিউশ লিখেছেন যে, ওয়ারশ গেটোর ট্র্যাজেডি নিয়ে, যার একজন চাক্ষুস সাক্ষী ছিলেন তিনি, তাঁর পক্ষে লেখা ছিল এক কঠিন কাজ। ইহুদি নিধনযজ্ঞের এক বছর পর পোলরা ১৯৪৪ সালে ওয়ারশ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শহরকে মুক্ত করার এক সাহসী কিন্তু সর্বনেশে উদ্যোগ গ্রহণ করে। শহরের উপকণ্ঠে  মিউশ ধরা পড়েন। হিটলারের বাহিনী তাঁকে এক অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্পে আটক রাখে। সে-রাতেই এক সাহসী ও কর্তৃত্বপরায়ণ নানের মাধ্যমে তিনি উদ্ধার পান, যে-জার্মান কর্তৃপক্ষের ওপর জোর খাটিয়েছিলেন যে, তিনি মিউশের আন্টি হন। তিনি তাঁর নাম জানতে পারেননি। ৬৩ দিনে আঠারো হাজার সৈন্য ও দুই লাখ বেসামরিক মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সুন্দর বারোক শহরের পঁচাশি ভাগই ধ্বংস হয়ে গেল। যুদ্ধের সময় এবং  যুদ্ধ-পরবর্তী অনেক কবিতাতেই তিনি গভীর সমবেদনায় যুদ্ধে নিহতদের কথা বলেছেন। যেমন ১৯৪৫ সালে লিখিত ‘উৎসর্গ’ কবিতায় তিনি যা লিখেছেন :

তুমি – যে-তোমাকে আমি বাঁচাতে পারিনি
আমার কথা শোনো।
এই সরল কথাটা বোঝার চেষ্টা করো তুমি,
যেহেতু অন্য কোনোরকম কথাই আমাকে লজ্জা দেবে।
আমি শপথ করে বলছি, আমার মধ্যে কথা দিয়ে কোনো

হাতসাফাই

কোনো চালাকি নেই।
আমি তোমাকে বলছি স্তব্ধতার ভাষায়, যে-ভাষায় কথা বলে
কোনো মেঘ কিংবা গাছ।

যা আমাকে শক্তিমান ক’রে তুলেছিলো, কারণ তুমি ছিলে
মারাত্মক।

একটা যুগের বিদায় আর নতুন যুগের সূচনাকে তুমি মিশিয়ে
ফেলেছিলে,

তুমি মিশিয়ে ফেলেছিলে ঘৃণার অনুপ্রেরণার সঙ্গে গীতল সৌন্দর্য,

অন্ধ পশুশক্তির সঙ্গে সুসম্পাদিত আকার।…

কাকে বলে কবিতা, যদি তা না-বাঁচায়

দেশ কিংবা মানুষকে?…

ওরা কবরগুলোর ওপর ছড়িয়ে দিতো খুদকুড়ো কিংবা আফিম ফুল

পাখির বেশ ধ’রে  যারা ফিরে আসবে সেইসব মৃতদের খাওয়াতে।
এখানেই আমার এই বই রাখি আমি, তোমার জন্য, যে-তুমি
একদিন বেঁচে ছিলে
যাতে তুমি আর আমাদের হানা না-দাও।

(অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)