পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ - (প্রথম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                  কবিতা হচ্ছে জ্ঞান আর কল্পনা। প্রাকৃতিক অবস্থা এবং মানব সমাজের বিভিন্ন পর্যায়কে বীক্ষণ ও পর্যালোচনা করার দক্ষতা, যার সাহায্যে সম্ভব হচ্ছে জ্ঞান বা চিন্তনের বিকাশ। কল্পনা যদিও একধরণের চিন্তন মানব মনের সচেতন প্রক্রিয়া, কিন্তু এ ক্ষেত্রে চিন্তার প্রকাশ ইমেজে। বলা যেতে পারে কল্পনা এমন এক শক্তি যার সাহায্যে মানুষ প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুতে মানবিক গুণ.অনুভূতি ও বৈশিষ্ট আরোপ করে থাকে।’’
         সঙ্গত কারণেই সৌন্দর্য সৃষ্টির নিয়মানুযায়ী শিল্প-সাহিত্য-কবিতায় যুগ ও সমাজ পরিবর্তনের ছাপ তাৎক্ষণিক নয়।
       ’মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চৈতন্যের নির্ধারক’।
        স্বাভাবিক ভাবে শিল্প-সাহিত্যিকরা যা কিছু নির্মাণ করেন তার মধ্য দিয়ে সামাজিক অবস্থানের চেতনাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিউসের কবিতায় আমরা এই সত্য মোটামুটি ভাবে লক্ষ্য করা যায়।
            চেসোয়াভ মিউশ-আমেরিকায় নির্বাসিত পোলিশ-কবি, সাহিত্যে নোবেল পেয়েছে ১৯৮০ সালে। তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার অনুবাদ করেছেন মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। বিশ্ব সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত এতো বড় একজন কবি(চেসোয়াভ মিউশ)-এর কবিতা প্রসঙ্গে বলবার আগে কবির সৃষ্টিকে বার বার পড়ে, বুঝে, (সময় নেয়া, পড়া, এবং পঠিত বিষয়গুলোর অনুভূতিকে অন্তরঙ্গ করে শিল্পসত্তার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করা।) তাঁর সৃষ্টির কালকে অনুধাবন করে তবেই তাঁকে বোঝা যাবে।
          কবির স্বদেশ পোল্যান্ড বেশ কয়েকবার বাইরের আক্রমণের মুখে পড়ে এবং তার স্বধীনতা বিপর্যস্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে ১৯৩৯ সালে জার্মানরা আকস্মিক আক্রমণ করে পোল্যান্ড দখল করে নেয়। পোলিশ সেনাবাহিনীর সামান্য প্রতিরোধ কোনো কাজে আসেনি। ফ্যাসিষ্টরা দখল করার পর দখলে এগিয়ে আসে সোভিয়েত বাহিনী এবং তারা পোল্যান্ডের শ্বেত রুশিদের অধ্যুষিত এলাকা প্রায় ৭৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার-এর ভাগ জার্মানদের কাছ থেকে গ্রহণ করে নিজদের নিয়ন্ত্রণে নেয় । শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কমিউনিষ্টরা প্রাধান্য বিস্তার করে এবং লাল ফৌজের সহযোগিতায় পোল্যান্ড মুক্ত হয়। এ'সব ঘটনাবলী কবির আবেগ আর অনুভূতিকে নানা ভাবে আলোড়িত করেছে এবং তার সৃষ্টিতে মৌলিক অনুসঙ্গ হয়ে আছে ।
        কবি পরবর্তীকালে পোল সরকারের বর্হিদেশের কুটনৈতিক দপ্তরে সংষ্কৃতি বিভাগের প্রধান হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ’কোল্ড ওয়্যার’ যুগে আমেরিকাতে আশ্রয় নিয়ে প্রবাসী হয়েছেন । আর এভাবেই তিনি দেশান্তরী কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন । কেন তিনি তা’ করেছেন তার কোনো উল্লেখ কবি পরিচিতিতে নেই। অনুমান তো করাই যায়, যদিও কবি প্রবাসী তবু তিনি ঐ সমাজের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বসবাস করে নিজভূমির ইতিহাস ঐতিহ্যকে আশ্রয়-প্রশ্রয়-অবলম্বন করে তার সৃষ্টিকে সক্রিয় রেখেছেন ।
         কবি তাঁর ’উৎসর্গপত্র’ কবিতায় বলেছেন ’কাকে বলে কবিতা, যদি তা না-বাঁচায় /দেশ কিংবা মানুষ?’
          কবিতা মানুষকে বাঁচাবে কিংবা বাঁচার দাবীতে সোচ্চার হবে, মানুষ কে আশান্বিত করবে এবং হতাশা ও গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য মানুষকে উদ্দীপ্ত করবে এমনটা যদি না হয় তো তাকে কবিতা বলবো কেন? কিন্তু তবুও কতো রকমের কবিতা রোজ লিখিত হচ্ছে পৃথিবী জূড়ে, আর তাতে কতো মত পথ ইত্যাদিরও প্রয়োগ রয়েছে। কিন্তু এমন উচ্চারণ তো সবটাতে আর থাকছে না যে ’যদি তা না বাঁচায় দেশ-মানুষ’ । এই ধরণের পঙক্তি নিশ্চয়ই ভিন্ন করে রূপ দিচ্ছে কবিতার উচ্চারণে।
          মিউশের এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই  থিয়োডর আডোরনোর সেই বিখ্যাত কথাটিও আমাদের মনে পড়বে : To write lyric poetry after Auschwitz is barbaric, ( আউশউইটজের পরে গীতিকবিতা লেখা বর্বরতা) বা তাদেউশ রুজেভিচের কথা, They forget/ that contemporary poetry/ means struggle for breath।(তারা ভুলে যায়/ সমসাময়িক কবিতা/ মানে নিঃশ্বাসের সংগ্রাম।) এইভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কবিতার মনস্তত্ত্ব  ও অনুভব বদলে যেতে শুরু করে কিছু কবিকে আশ্রয় করে। এখানে মনে রাখা উচিত, যুদ্ধোত্তর নন্দন ও আলোকদীপ্তির ভাবনায় তাৎপর্যগত পরিবর্তন এসে গেল, কবিতা প্রথাগত নন্দনবোধ আর শিল্পভাবনায় নিজেকে আটকে রাখল না, ধরতে চাইল ননদনতত্ত্বের ও আলোকায়নের দ্বন্দ্বগুলোকে, তাদের খোলনলচে গেল পালটে। আডোরনো এবং হোর্কহাইমার তাঁদের বিখ্যাত কাজ ডায়ালেকটিক অব এনলাইটেনমেন্টে বলেছেন, তথ্যপ্রবাহ এবং ব্র্যান্ড-নিউ বিনোদন মানুষকে অধিকতর স্মার্ট করেছে ঠিকই; কিন্তু তার চেয়েও বেশি করেছে নির্বোধ। সৌন্দর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যা ক্যামেরা উৎপাদন করে। সংস্কৃতি এখন আপাতবিরোধী পণ্য আর বিজ্ঞাপন হলো জীবনের সর্বরোগহরকর বিশেষ একটা-কিছু। তাঁরা তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থে আরো বলেছেন, অষ্টাদশ শতকের আশাবাদ বা মানবতাবাদ এক চূড়ান্ত ভ্রান্ত ধারণা, কান্টের ‘আলোকদীপ্তি কী’ এক বাতিল বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে যে, পশ্চিমা সভ্যতার অন্তরালে অপেক্ষায় রয়েছে এক পশুশক্তি , যে সুযোগ পেলেই ঘাড় মটকে ধরতে ভুল করে না। এই প্রতি-ভাবনা ও রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বিংশ শতাব্দীর কবিতা ভাবনার যে-সমস্ত ভাঙচুর এবং পরিবর্তন এলো ,