পারস্যের কবিতা (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


মাওলানা জালালউদ্দিম রুমি - এর কবিতা
------------------------------------------------------

                         রুমির (মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি,(১২০৭ সাল - ১২৭৩ সাল) মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সর্ব ধর্ম এবং সর্ব বিশ্বাসের লোকেরা এসেছিল। একজন মুসলিম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কেন এসেছো? তা'রা উত্তর দিলো, ‘তাঁর কবিতা  আমাদের সমস্ত জীবনকে, আমরা এই পৃথিবীতে যে-যেখানেই যে-জীবন যাপনই করি না কেন, তাকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছেন।’
— এই হচ্ছে সেরা পারস্য প্রতিভা, কবি রুমি। আপনি যে মুহূর্তে এই লেখাটি পড়ছেন, সেই মুহূর্তেও পৃথিবীর কোনো-না-কোনো প্রান্ত থেকে রুমির কবিতার বই বিক্রি হচ্ছে। বলা হয় যে, কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া কবিতার বই, রুমির কবিতার বই।
কেন?
সে জিজ্ঞাসা পাঠকের মনেও জেগে উঠুক। এখানে তাঁর কয়েকটি কবিতার ভাবানুবাদ পেশ করা হলো। কবিতাগুলো তাঁর “খরঃঃষব নড়ড়শ ড়ভ ষরভব” থেকে নেওয়া হয়েছে।

১).

" একদিন খুব ভোরে বাগান থেকে
আমি একটি ফুল তুললাম,
হঠাৎ করে বাগানের মালী এসে পড়লো,
এবং
আমি ভয়ে আতংকে
থর থর করে কাঁপতে লাগলাম,

মালী বললো,“যেখানে আমি
সমস্ত বাগান তোমাকে দিয়ে দিয়েছি,
সেখানে একটা ফুলের জন্য
তুমি  দুশ্চিন্তা করছো!”

২).

" জ্ঞানোনমত্ত পণ্ডিত,
নেমে এসো চূড়া থেকে,
এমনভাবে ডুবে যাও
প্রেমের গভীরে, যেন তুমি
নির্জ্ঞান, নির্বোধ!

একটি ধূলির বিনয় জাগুক
তোমার শরীরে,
কী তরুণ, কী বৃদ্ধ, কী ভালো,
কী মন্দ,– এ- যাত্রায় যদি
সাথে নাও সবাইকে, তবেই
তুমি  হবে অধিশ্বর, একদিন।"

৩).

" তোমার সমস্ত ঝুড়ি ভরে আছে রুটিতে,
তবু তুমি সামান্য এক টুকরো
রুটির জন্য
ঘুরে বেড়াচ্ছ দ্বারে দ্বারে।
তোমার হাঁটু অব্দি জল,
তবু
যেই চলে গেল এই পথ দিয়ে
তার কাছে চাইলে
এক ফোঁটা তৃষ্ণার জল।
কেন তুমি এত অন্ধ,অচল?

সব ছেড়ে ফিরে আসো,
শুধু হৃদয়ের কাছে
ভিক্ষা চাও। "

৪).

" হৃদয়, বিবেচক হও,
আত্মা, সহিষ্ণু হও,
ধৈর্য, যদি বইতে না পারো
দুঃখের ভার, তবে পালাও,
আর যুক্তি, যাও, তুমি তোমার
শিশুতোষ খেলাগুলো খেলো। "

৫).

" যে দুঃখ হৃদয়ের গভীরে,
যদি প্রকাশ করো,
সে নেই হয়ে যাবে।

একটি ফুলের দিকে তাকাও,
দেখো,
সে কখনোই তার
গন্ধ, রঙ
কিছুই লুকোয় না। "

৬).

" তোমাকে হারানোর পর থেকে,
এই বসন্ত আর কোনো আনন্দ বয়ে আনেনি,
সমস্ত বাগান ঢেকে গেছে কাঁটায়,
সমস্ত পাথর গলে বৃষ্টি পড়ছে।"

৭).

" নিজেকে হারিয়ে
আমি ঈশ্বরের অনুবাদক বনে গেলাম,
এখন, পানোনমত্ত অথবা অনুনমত্ত,
যে অবস্থায়ই থাকি না কেন,
মুখ থেকে কোনো শব্দই আর বের হয় না।"

৮).

" আমার সমস্ত শিরায় প্রেম বয়ে গেল,
এবং আমি শূন্য হয়ে গেলাম।
এখন আমার সমস্ত জুড়ে আছে সে,
আর আমার সম্পদ বলতে নিজের
নাম ছাড়া আর কিছু নেই। "

৯).

" রাতে প্রবল বায়ুর মতো
আমি শহরময় বিচরণ করি,
ঘুম নেই চোখে,
ভদ্রলোকেরা
বারবার
বিষয়-বুদ্ধির দিকে আমার চোখ ফেরাতে চায়,
কিন্তু আমার মন তা শুনতে অপ্রস্তুত,

কারণ ভালোবাসার এই মদে
আমি
লুপ্ত এবং মত্ত হয়ে আছি। "

১০).

" আমার চিন্তা গভীর আবেগের মধ্যে
ঘুরপাক খাচ্ছে,
আমার হৃদয় বাতাসের মধ্যে ঘুরছে,
যেমন করে উঁচুতে
পাখিরা ঘুরতে থাকে,
আমার সত্ত্বার
প্রতিটা পরমাণু ঘুরছে,
আমার ভালোবাসার মানুষও কি
ঘুরছে—- সমস্ত চরাচরে,
এমনি করে?"

তাঁর আরও দুটি খন্ড-কাব্য

১).
হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা গোপন কথা, আর মিথ্যাচার
চোখের তারায় দৃশ্যমান দিনের মত পরিষ্কার।

২).
হৃদয়ের নেই কোন দেশ …
তবে রুমির প্রেমবাদ আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার একশ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক চারণ কবি নিজামি গানজাভির মহাকাব্যের কারণে।


গানজাভি
------------------------------------------------------

          গানজাভি নামটির উৎপত্তি গানজা এলাকা থেকে (তার নামের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে গানজা নামের এলাকার নিজাম নামক ব্যক্তিটি) যা বর্তমানে আজারবাইজানের অংশ।
এখানে তার কিছু মহাকাব্যে খসরো ও শিরিন থেকে কিছু চরণ তুলে ধরা হল, খসরো ছিলেন এক সাসানীয় শাসক তিনি আর্মেনিয়ার রাজকন্যা শিরির হৃদয় জয় করার জন্য নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরহাদের সাথে কবিতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন - তুমি কী হৃদয় দিয়ে বেসেছ ভালো?
উত্তর - তোমার হৃদয় বলে কথা, আর আমি বলি আত্মা দিয়ে,
প্রশ্ন - কখন তুমি তোমার ভালবাসা থেকে নিজের হৃদয় সরিয়ে নেবে?
উত্তর - যখন আমি কেবল কবরে শায়িত হব
প্রশ্নে বলা হল - হৃদয় থেকে শিরিনের ভালবাসা মুছে ফেলো
উত্তর এলো - তবে আমি আমার আত্মা ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে?


আইয়ান আল কোজাত হামাদানি’র কবিতা
--------------------------------------------------------

       আইয়ান আল কোজাত হামাদানি পারস্যের হামেদান শহরে ১০৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত দার্শনিক এবং মরমী সাধক। জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁর কেটেছে জেলে। তেত্রিশ বছরের জেল হয়েছিল তাঁর বিধর্মের জন্য। তিনি বিখ্যাত আবু হামেদ গাজ্জালীর উপর ব্যাপক পড়াশোনা করেন এবং পরে তাঁর ভাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর ভাইয়ের কাছে লেখা চিঠিগুলি জগৎ-বিখ্যাত। তাঁর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ ‘তামহিদ’, এটা শুধুমাত্র ফরাসি ভাষায় অনুবাদ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে তাঁর একমাত্র যে অনুবাদটি পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে, ‘সাকওয়া-ই-গারিব”। এই বইটি তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে, জেলে থাকা অবস্থায় লিখেছিলেন। নীচে যে কবিতাটি দেওয়া হলো , সেটি তাঁর সবচেয়ে বহুল পঠিত কবিতা।

খণ্ডাংশ ১

না-থাকার গভীরে আরো
এক গভীর না-থাকা,
সেই আমার নিয়ম।

হারিয়ে যাবার গভীরে
আরো এক গভীর
হারিয়ে যাওয়া,
সেই আমার ধর্ম।

খণ্ডাংশ ২

আমি জানি,
এই-যে যেখানে তুমি আছো,
সেখানে আমি আসতে পারি না ;

আমি জানি,
এই-যে যেখানে আমি আছি,
সেখানে তুমি আসবে না ;
আমি জানি।

খণ্ডাংশ ৩

হায়! ঐ চোখ কী
কখনো তার
মুখ দেখেনি!

ঐ হৃদয় কী
কখনো তার
চোখের পাপ
অনুভব করেনি!

পরম তৃষ্ণা আমার

যতদিন এই প্রাণ প্রাণময়,
তোমাকে ভালোবাসার

দুঃখ আমি
পান করে যাব,
মৃত্যুর কালেও
কাউকে দেবনা
তার ভার,

কাল
পুনরুত্থানের দিনে,
এই পরম তৃষ্ণা নিয়ে
হেঁটে যাব সম্মুখে।

নিষিদ্ধ হেরেম
------------------

যদি আমার পা দুটো অসার
হয়ে আসে, তোমার পিছে
ছুটবো না, ভেব না

আমার হৃদয় তোমার

ভালোবাসার জালে আটকা পড়েনি,
ভেব না, তোমার প্রেম বহুজনে,
এই ভেবে আমি স্থাণু;
আমার চোখ নিষিদ্ধ হয়ে আছে
তোমার দৃষ্টির হেরেমে।

দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে যে
-----------------------------------------
আমার সমস্ত স্বপ্ন জুড়ে ছিলো সে,
ঠোঁটের উপরে ঠোঁট,
স্তন ছুঁয়ে ছিলো স্তন;
তার কানে কানে বললাম,
“আমার হৃদয়, এই রাত্রিকে
অশেষ করে তোলো…”
হঠাৎ জেগে উঠে দেখি,
আমি শুধু দরজায়
কড়া নেড়ে চলেছি।

নাজমদ্দিন কোবরা
-------------------------------------------------------

              নাজমুদ্দিন কোবরা ১১৪৫ সালে খিভায় (খাওয়ারাজাম নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি এখানেই কাটান। তিনি বিদ্যাশিক্ষার জন্য নিশাপুর, পরে, মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় যান, যেখানে তিনি রাজবেহান আল-ওয়াযান আল-মেসরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজে একজন মহান সুফি সাধক ছিলেন। ১২২১ সালে তিনি যুদ্ধে মারা যান।

নীচের কবিতাটি তাঁর বহুল পঠিত একটি কবিতা।

" যা-কিছু অস্তিত্বমান নয়, তা
হাতে একমুঠো হাওয়া ছাড়া আর
কিছুই রেখে যায় না;
যা-কিছু  অস্তিত্বমান, তা
ব্যর্থতা ও অপূর্ণতা ছাড়া আর
কিছুই দিতে পারে না ;

সেক্ষেত্রে, একজন শুধু স্বপ্ন দেখতে
পারে তারই—-যা কখনই ছিল না;
এবং সেজন্যই সে সত্য;
মনে রেখো,
এই সত্য কখনোই অস্তিত্বমান নয়।"


এমনকি আরো খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া যাক (৮৫৮ সাল - ৯৪১ সাল), পাঞ্জিকেনতে (আধুনিক তাজিকিস্তান ) কবি রুদাকি, কারও কারও মতে যে ফার্সী কবিতার পুরোধা।

" তোমার ভালবাস আস্থা আর আমার আত্মা ছিনিয়ে সুন্দর মুখশ্রী আমার মন ও হৃদয়কে করে ফেলে এলোমেলো
আমার হৃদয়ে যে বিষাদ, এক পাহাড় চেপে রাখা বুক
তোমার বক্ষের নীচে পাথর হৃদয়, নেইকো যেথায় দুঃখ সুখ,
একদিন আমি স্মৃতির মাঝে হব বিলীন
প্রিয়ে, তুমি তোমার স্মৃতির মাঝে আমার হৃদয় খুঁজে দেখো
আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি আমার হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে।।
কারণ তারা আমাকে এক শীতল শরতে আটকে রেখেছে… "