পাবলো নেরুদা ও তার কবিতা (প্রথম পর্ব)
(লাতিন আমেরিকান বিপ্লবী কবি)
শংকর ব্রহ্ম
"আমরা অর্থাৎ ভবঘুরে কবিরা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছি, খুঁজেছি তাকে—জীবন আমাদের স্বাগত জানিয়েছে—প্রতিটি দরজায় দরজায়—মাটি-কাদা-জলের সংগ্রামে’'
— এমন করে লিখেছেন যে কবি, তিনিই পাবলো নেরুদা। চিলির এই বিপ্লবী কবির কবিতার অনুবাদ এবং তাঁর কবিতার জগৎ সম্পর্কে একটি ভূমিকা।
আজ লাতিন আমেরিকার ও হিস্পানি ভাষার অন্যতম প্রধান কবি পাবলো নেরুদা।
১২ই জুলাই ১৯০৪ সালে দক্ষিণ চিলির এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আর মারা যান ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে, মাত্র ৬৯ বছর বয়সে।
তিনি জন্মেছিলেন যে নাম নিয়ে, তা ছিল বেশ দীর্ঘ—রিকার্দো এলিয়েসের নেফতালি রেইয়েস বাসোয়ালতো। পরে লেখক হিসেবে তিনি পাবলো নেরুদা নামটি গ্রহণ করেন। চেকোস্লাভাকিয়ার উনিশ শতকের প্রধান ও প্রভাবশালী কবি ও সাংবাদিক 'ইয়ান নেরুদা'-কে স্মরণ, সম্মান ও অনুসরণ করেই তিনি সেই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। নেরুদার জীবন ছিল নিঃসন্দেহে এক মহাকাব্যিক আয়তনের অভিযাত্রা, যার বৈচিত্র্য ও বিস্তার এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় ধরা মোটেই সম্ভব নয়। তবে নেরুদার যে তিনটি কবিতার অনুবাদ এখানে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে বিশেষভাবে বিবেচনায় রেখেই তাঁর জীবন ও কাজের গুটিকয়েক দিককে স্পর্শ করাই হবে এই ভূমিকার উদ্দেশ্য।
১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া পাবলো নেরুদা মূলত প্রেমের কবি হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিত। তাঁর অসাধারণ প্রেমের কবিতার কারণেই তিনি ২০ শতকের সর্বাধিক অনূদিত কবি, যদিও সম্প্রতি এ-ও বলা হচ্ছে, সব ভাষায় তাঁর সব কবিতা এখনো অনূদিত হয়নি। আর যাকে ‘বিশ্বসাহিত্য’ বলা হয়, তার ইতিহাসে যেসব কবিতাকে সচরাচর ‘কালোত্তীর্ণ’ ও ‘মহৎ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, তাদের অধিকাংশই প্রেমের কবিতা। তবে প্রেমের কবিতারও রকমফের থাকে, যার প্রমাণ নেরুদার নিজের কাজেই মেলে। তাঁর কবিতায় আন্দোলিত বা এমনকি উন্মাদ প্রেমিক কর্তাসত্তা যেমন লিরিকের ঘনিষ্ঠ—এমনকি ভীষণ সেন্টিমেন্টাল—উচ্চারণে হাজির থাকে, তেমনি নেরুদা এমন কবিতাও আমাদের উপহার দিয়েছেন, যেখানে প্রেম একদিকে নির্দিষ্ট সময় ও স্পেসকে ধারণ করে মানুষের সম্পর্ককে উৎসাহে উদযাপন করে এবং অন্যদিকে সেই প্রেম বিরাজমান অবস্থা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে অনিবার্য করে তোলে। অন্য কথায়, নেরুদার কবিতায় প্রেমও হয়ে ওঠে তুমুলভাবে বৈপ্লবিক।
ঊনসত্তর বছরের জীবনে নেরুদা অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। কবিতার বিচিত্র ফর্ম নিয়েও তিনি বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর অনেক কবিতায় লিরিকের ‘আমি/তুমি’ সম্পর্ক যেমন অটুট থেকেছে, তেমনি সেই সম্পর্ক রূপান্তরিত হয়েছে মহাকাব্যিক সমষ্টিতেও। আর এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় নেরুদার কবিতায় মুখ্য হয়ে উঠেছে সর্বসাধারণের পক্ষাবলম্বন করে অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। এতে কবিতার নান্দনিক গুণও অক্ষুণ্ন থেকেছে বটে। নিজেতে-নিজে-ফুরানো কলাকৈবল্যবাদ ও তথাকথিত শুদ্ধতাবাদকে নেরুদা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলে উঠেছিলেন: ‘চাই সেই কবিতা যা একই সঙ্গে ঘাম আর ধোঁয়ায় ঠাসা, যা একই সঙ্গে ফুল আর প্রস্রাবের গন্ধভরা, যা আমাদের পরিহিত পোষাকের মতোই অশুচি কিংবা আমাদের দেহের মতোই দূষিত।’
আসলে নেরুদা সেই কবিতার জন্য আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন যে কবিতায় পোড় খাওয়া সাধারণ মানুষের হাতের ছাপ দৃশ্যমান থাকে—সেই কবিতা যেখানে, নেরুদার নিজের ভাষায় , ‘দোআঁশ মাটি থাকে, যেখানে পানি গান গেয়ে যায়, সেই রুটির কবিতা যেখানে সকলেই খেতে পায়।’
নিজ প্রতিভাবলেই নেরুদা অবশ্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কবিতাকে দিয়েছিলেন এমন এক বাস্তুবতা, এমন এক জীবন ও প্রাণ যে, তাঁর দেশের কৃষক-শ্রমিক স্মৃতি থেকেই পথে-ঘাটে-মাঠে তাঁর কবিতার অসংখ্য লাইন বলে যেতে পারতেন। একবার নেরুদা ট্রেনে চড়ে তাঁর শহর ছেড়ে গেছেন অন্য এক মফঃস্বল শহরে। সেখানে তিনি ট্রেন থেকে নামার আগেই জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলেন শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের ঢল। নেরুদাকে এক পলক দেখার জন্য এবং তাঁদের শহরে নেরুদাকে স্বাগত জানানোর জন্যও ওই সব মানুষ এসেছিলেন শুধু মালা নিয়ে নয়, তাঁরা এসেছিলেন তাঁদের স্মৃতিতে রাখা নেরুদার অবিনাশী কবিতা নিয়েও। অর্থাৎ শ্রমিকেরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই নেরুদাকে শুনিয়েছিলেন নেরুদারই কবিতা!
নেরুদার জীবনীকারেরা এ-ও জানিয়েছেন, তাঁর কণ্ঠে কবিতাপাঠ শোনার জন্য মানুষের ঢল নামত এত প্রবলভাবে যে তাঁর কবিতাপাঠের জন্য রীতিমতো স্টেডিয়াম ভাড়া করতে হতো। একবার তাঁর কবিতা শোনার জন্য চিলির কোনো এক স্টেডিয়ামে জমায়েত ঘটেছিল কমপক্ষে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের। যথার্থ কারণেই আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ কিংবা ফিলিস্তিন কবি মাহমুদ দারবিশের মতোই পাবলো নেরুদাও নন্দিত হয়েছিলেন ‘জনগণের কবি’ হিসেবে। আর তাঁকে ‘বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি’ আখ্যা দিয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার প্রধান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।
নেরুদার অভিজ্ঞতা আর কবিতার বৈচিত্র্য, বিস্তার ও বৈভবকে বিবেচনায় রাখলে তাঁর কোনো দ্রুত ও একমাত্রিক চরিত্রায়ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রেমের কবি ও জনগণের কবি বলা ছাড়াও তাঁকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে প্রতিবাদী কবি, বিদ্রোহী কবি, রাজনৈতিকভাবে লিপ্ত কবি প্রভৃতি। তবে নেরুদার নিজ ভাষ্য মোতাবেক, তিনি ‘কমিউনিস্ট’ ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি এমনকি চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দিয়েছিলেন। আর কমিউনিস্ট হওয়ার কারণেই রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে তিনি নিজ বাসভূমে পরবাসী ও ছদ্মবেশে থেকে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন বিদেশে, অর্থাৎ আর্জেন্টিনায়। বিশেষভাবে বলা দরকার, নেরুদা ছিলেন লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়া চিলির ২৮তম প্রেসিডেন্ট (১৯৭০-১৯৭৩) সালভাদোর আয়েন্দের (১৯০৮-১৯৭৩) সমর্থক, ঘনিষ্ঠজন, কমরেড। আয়েন্দে ছিলেন সারা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে জনগণের ভোটে প্রথম নির্বাচিত মার্ক্সবাদী প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তিনি তিন বছরের বেশি টিকতে পারেননি, কেননা ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সিআইএ ও চিলির সামরিক বাহিনী। আয়েন্দের ও গণতন্ত্রের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তারা পিনোশের একনায়কতন্ত্রকে জায়গা করে দিয়েছিল।
আয়েন্দের মৃত্যুর কারণ খুন না আত্মহত্যা,তা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। তবে আয়েন্দের মৃত্যু নেরুদাকে দারুণভাবে আলোড়িত, বিষণ্ন ও শোকগ্রস্ত করে তুলেছিল। কমরেড আয়েন্দের মৃত্যুর মাত্র ১২ দিন পরই নেরুদাও মৃত্যুবরণ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে আইনি কারণেই বেশ কিছু চিকিৎসাগত অনুসন্ধান এই জল্পনাও উসকে দিয়েছে, নেরুদার মৃত্যুও স্বাভাবিক ছিল না, বরং তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
নেরুদা নিজেকে কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না। সম্প্রতি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত বই ‘দ্য এজ অব দ্য পোয়েটস’-এ বর্তমান সময়ের একজন প্রধান দার্শনিক—এবং ফরাসি দার্শনিক—আল্যান বাদিউ নতুনভাবে কমিউনিস্ট কবি হিসেবে হাজির করেছেন পাবলো নেরুদাকে এবং এমনকি এই সাহসী ধারণাকেও সামনে এনেছেন যে চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে কমিউনিজমের সঙ্গে কবিতার কোনো বিরোধ নেই, বরং তাদের রয়েছে স্বাভাবিক সম্পর্ক। নেরুদা নিজেও তা-ই মনে করতেন। এখানে আরও বলা দরকার, বিপ্লবী, গেরিলাযোদ্ধা, কমিউনিস্ট, কবি ও কবিতাপ্রেমী চে গুয়েভারার বুকপকেটে যাঁদের কবিতা থাকত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নেরুদা, যাঁকে আরেক কমিউনিস্ট কবি ও নেরুদার বন্ধু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বলেছিলেন ‘সর্বসাধারণের সাচ্চা প্রতিনিধি’ এবং ‘সময়ের দারুণ কণ্ঠস্বর’।
নেরুদা বহুপ্রজ কবি। তাঁর কবিতাসমগ্র বারবার মুদ্রিত হয়েছে। ১৯৫১ সালে তাঁর কবিতাসমগ্রের মোট পৃষ্ঠা ছিল ৮৫৯; ১৯৬২ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়াল ১,৯২৫-এ এবং ১৯৬৮ সালে ৩,২৩৭-এ। লেখক জ্যাকি ক্রেইভেনের দেওয়া সর্বশেষ হিসাব অনুসারে নেরুদার প্রকাশিত কবিতার পরিমাণ ৩৫ হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর অসংখ্য কবিতা-সংকলনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (এখানে ইংরেজি অনুবাদেই তাঁর হিস্পানি কবিতার বইয়ের শিরোনামগুলো) : ‘টুয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড আ সং অব ডেসপেয়ার’, ‘দ্য হাইটস অব মাচুপিচু’, ‘ওয়ান হানড্রেড লাভ সনেটস’, ‘দ্য ইয়েলো হার্ট’, ‘ক্যান্টো জেনারেল’, ‘স্পেইন ইন আওয়ার হার্টস’, ‘দ্য বুক অব কোয়েশ্চেনস’, ‘অন দ্য ব্লু শোর অব সাইলেন্স’, ‘ইনটিমেসিস: পোয়েমস অব লাভ’, ‘অল দ্য ওডস’ ও ‘বুক অব টোয়াইলাইট’।
নেরুদা যেমন বহুপ্রজ কবি ছিলেন, তেমনি তিনি বহু আঙ্গিকে, বিচিত্র বিন্যাসে ও ফর্মে কবিতা লিখেছেন। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ফর্ম হচ্ছে ওড। সনেটও তাঁর প্রিয় ফর্ম। তাঁর কবিতা-সংকলন ‘এক শ প্রেমের সনেট’ নিঃসন্দেহে নেরুদার আঙ্গিকনৈপুণ্যের মোক্ষম উদাহরণ। কিন্তু সনেটের পরিমিতি ও ঘনত্বের নান্দনিকতা তাঁর প্রিয় হলেও নেরুদার কাছে তার চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল ওডের স্থিতিস্থাপকতা, ব্যাপ্তি, বিস্তার, ব্যঞ্জনা, বহুমাত্রিকতা, বস্তুকতা আর অনিয়মিত কিন্তু ঢেউখেলানো ছন্দ।
আজীবনই নেরুদা ওড লিখেছেন। তবে বয়স পঞ্চাশ পেরোবার পর থেকেই তিনি ওড লেখার দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েছিলেন। নেরুদা সর্বমোট ২২৫টি ওড লিখেছিলেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি ভিন্ন সময়ে তিনটি আলাদা খণ্ডে তাঁর ওডগুলো প্রকাশিত হয়েছিল এবং সহজেই সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছিল।
কিন্তু কী এই কাব্যরূপ যার নাম ওড? সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়: ওড হচ্ছে এক ধরনের গাথাকবিতা, এক ধরনের স্তোত্রও, যা নিয়মিত ছন্দে যেমন লিখিত হয়েছে, তেমনি তা অনিয়মিত বা মুক্ত ছন্দেও লিখিত হয়েছে এবং যা কোনো বিশেষ ঘটনা, অভিজ্ঞতা, বস্তু বা এমনকি ব্যক্তিরও মহিমাকীর্তন করে থাকে। ওড লেখার ক্ষেত্রে যাঁরা নেরুদাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাঁরা হলেন পিন্ডার, হোরেস, ওভিড, কাত্তুলাস, এমনকি হোমার এবং অবশ্যই কিটস্। তবে নেরুদা হিস্পানি ভাষায় এই ওডের শক্তি ও সম্ভাবনাকে সম্প্রসারিত করেছেন এমনভাবে যে তাঁর কবিতায় জগৎ, জীবন ও প্রকৃতি তাদের তাবৎ ঐশ্বর্য ও তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত ও উদ্ভাসিত হয়েছে আপাত-তুচ্ছ বিষয় ও বস্তুর অসাধারণ মহিমাকীর্তনের ভেতর দিয়ে।