পাবলো নেরুদা ও তার কবিতা  (দ্বিতীয় পর্ব)
(লাতিন আমেরিকান বিপ্লবী কবি)
শংকর ব্রহ্ম


           নেরুদার ওড পড়তে গিয়ে মনে পড়ে যায় আমাদের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেই, যিনি হাল আমলের নিম্নবর্গের ইতিহাসতাত্ত্বিকদের আগেই এক অর্থে ‘জগতের লাঞ্ছিত-ভাগ্যাহত’-দের ইতিহাস লেখার ডাক দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আরও সূক্ষ্ম, আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চাই। আজকের তুচ্ছতা হাজার বছর পরের মহাসম্পদ। মানুষ মানুষের বুকের কথা শুনতে চায়।’
এই ডাকটারই যেন উত্তর দিয়েছেন নেরুদা তাঁর ওডগুলোতে।
          আমাদের বিভূতিভূষণকে না পড়েই যেন তাঁকেই টুকে দিয়েছেন আমার এক প্রিয় গ্রিক কবি এবং নেরুদার সমসাময়িক—অদিসেয়াস এলিতিস। তিনি বলছেন: ‘তুচ্ছকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করো।’ নেরুদা যে সেটা করেছেন তা  বলা যাবে নির্দ্বিধায়। আর পুঁজিতান্ত্রিক পণ্য-ফেটিশিজমের যুগে আমাদের শৃঙ্খলিত ও এমনকি ভোঁতা হয়ে যাওয়া ইন্দ্রিয়কে মুক্ত ও জীবন্ত করার তীব্র তাগিদেই নেরুদা তাঁর ওডগুলোতে তুচ্ছ যে তুচ্ছ নয়, সেই বোধ ও সত্যটাকে সঞ্চারিত করেছেন সুষমায়, সাংগীতিকতায়, আধ্যাত্মিকতায়, বস্তুকতায়, রাজনীতিকতায়—এমনকি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকতায়।
           এই কারণে নেরুদার ওডগুলোতে বিষয় হিসেবে অনায়াসেই এসেছে মোজা কিংবা জুতা, ঝিলিক দেওয়া চায়ের পেয়ালা, কিংবা পেঁয়াজের কংক্রিট প্যাঁচ, কমলালেবুর অন্তর্গত সংহতি ও শিখা, লেবু ও লবণ, কৃষকের লাঙলের ফলা, কৃষকের বীজ, কচকচ করা কাঁচি, সাবান-বিছানা-চামচ-চেয়ার, কাঁটাতার, কপার, ক্যাকটাস, ভাঙা জিনিস, রুটি, মাটি, আগুন, বাসন, বচন প্রভৃতি। তাঁর ভীষণ প্রিয় মানুষদের নিয়েও নেরুদা ওড লিখেছেন, যেমন তিনি লিখেছেন লোরকা ও লেনিনকে নিয়ে। তুলনামূলকভাবে সিরিয়াস ও পরিচিত বিষয় নিয়েও ওড লিখেছেন নেরুদা। সেসব বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৃষ্টি, বই, এমনকি সমালোচনাও। কিন্তু সেই সব বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়েও নেরুদা তুচ্ছকে সামনে আনতে ভোলেননি।
          নিচে নেরুদার দুটি ওডের অনুবাদ। মূল হিস্পানিসহ বেশ কিছু ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণ করেই বাংলায় নেরুদার অনুবাদ ।

১).
সমালোচনাগাথা

পাঁচটা কবিতা লিখেছিলাম:
একটা ছিল সবুজ
আরেকটা ছিল গোলগাল গমের রুটির টুকরা
তৃতীয়টা ছিল একটা বাড়ি, একটা ইমারত
চার নম্বরটা ছিল একটা আংটি
আর পঞ্চমটা ছিল বিদ্যুতের ঝলকানির মতো অল্প মুহূর্তের
এবং যেহেতু কবিতা লিখেছিলাম
সে নিজেই আমার কারণকে ছাপ দিয়ে আমার কথা জানান দিল।

তো, পুরুষ
আর নারী
এল আর গেল
আর সঙ্গে নিয়ে চলল
আমার সহজ সরল সঞ্চয়—
হালকা বাতাস, ঢেউ-খেলানো বাতাস,
বর্ণচ্ছটা, কাদা, কাঠ
আর এই সব সাধারণ জিনিসপত্র দিয়েই
বানাল দেয়াল, মেঝে আর স্বপ্ন।

আমার কবিতার একটি পংক্তির ওপর
তারা ঝুলিয়ে রাখল সূর্যের আলোতে ভেজা কাপড়।
আমার শব্দগুলো হয়ে উঠল তাদের রাতের খাবার।
আমার শব্দগুলোকে রেখে দিল
তাদের মাথার বালিশের পাশে।
কবিতার সঙ্গে শুরু হলো তাদের বসবাস,
শুরু হলো বসবাস সেই আলোর সঙ্গে
যে আলো আমার পাশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।

তখন এল এক নিঃশব্দ সমালোচক।
তারপর এল বাচালের পাল
এবং এল আরও অনেকেই—
কেউ কানা, কেউ নাকি সব দেখে, সর্বদ্রষ্টা,
তাদের মধ্যে কেউ কেউ দারুণ মার্জিত পরিচ্ছন্ন রুচিমান
কেউ কেউ এমনকি লাল জুতার বর্ণচ্ছটার মতো উজ্জ্বল
কেউ কেউ লাশের মতো কাপড়চোপড়ে ভীষণ পরিপূর্ণ।
কেউ কেউ আবার উন্নীত রাজতন্ত্রের
দলবাজি করে,
কেউ কেউ মার্ক্স মহাশয়ের ঘন দীর্ঘ ভুরুতে আটকে গিয়ে আর ঝুলে থেকে
তার দাড়িতে ঠ্যাং দিয়ে লাথি মেরে যাচ্ছিল।
কেউ কেউ ইংরেজ
পুরাদস্তুর ইংরেজ
এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ
দাঁত আর ছুরি নিয়ে
ঢাউস অভিধান আর গুপ্ত অস্ত্র নিয়ে
মাননীয় উদ্ধৃতিসমূহের কুচকাওয়াজ নিয়ে
কবিতা পড়ার যাত্রা শুরু করল।
তারা কবিতা পড়ার যাত্রা শুরু করল,
যে মানুষগুলো আমার কবিতা ভালবাসতো
সেই সহজ-সরল সুন্দর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে
আমার কবিতাকে ছিনতাই করার জন্য।

তারা কবিতাকে ফাঁদে ফেলে মশকরায় মেতে থাকল।
তারা কবিতাকে ঠোঙা বানাল,
তারা কবিতার ভিতরে কয়েক শ পিন ঢুকিয়ে তাকে
নিরাপদে রাখতে চাইল তাদের জন্য।
কবিতাকে ঢেকে রাখল কঙ্কালের ঝুরঝুরি দিয়ে
অথবা কবিতাকে কালির মধ্যে চুবাতে থাকল,
বিড়ালের বদান্যতার নামে কবিতার ওপর থুতুও ছিটাল।
কবিতাকে ব্যবহার করল ঘড়ি মোড়াবার কাপড় হিসেবে।
মনে করলো তারা কবিতাকে রক্ষা করে যাচ্ছে এভাবে।
কাঁচা তেলের সঙ্গে কবিতাকেও তারা মজুত করল
আর কবিতাকে উৎসর্গ করে চলল
তাদের স্যাঁতসেঁতে রচনাবলি কিংবা অভিসন্দর্ভ।
তারা মাঝেমাঝে দুধ দিয়ে কবিতা সিদ্ধ করল,
নুড়ি দিয়ে কবিতাকে গোসল করাল।
আর এই প্রক্রিয়ায় কবিতা থেকে মুছে ফেলল
তার জ্বলজ্বলে স্বরবর্ণ, তার শব্দের টুকরো, তার দীর্ঘশ্বাস।
কবিতাকে তারা প্রায় খুন করে বসল।
তারা কবিতাকে দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে হাত-পা বেঁধে রেখে দিল
এক প্যাকেটে।
তারপর কবিতায় থাকা চিলেকোঠা আর গোরস্থানকে
সম্বোধন করল।

তারপর
একের পর এক তারা অবসর নিল—
পাগলের মতো খেপে উঠল আমার ওপর
কারণ আমি তাদের জন্য যথেষ্ট ‘জনপ্রিয়’ নই।
অথবা আমার কবিতায় নিয়মমাফিক ভুতুড়েপনার অভাবের প্রতি
খানিকটা ঘৃণায় কাতর হয়ে
তারা বিদায় নিল।
সকলেই।

এবং তারপর
আরও একবার
নারী আর পুরুষ
এল
আমার কবিতার সঙ্গে
থাকবে বলে।
আরও একবার
তারা জ্বালাল আগুন
গড়ে তুলল ঘরবাড়ি
বানাল রুটি
ভাগাভাগি করে নিল
আলো সূর্য মাটি কাদা কাঠ
এবং ভালোবাসায়
বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে
আংটির সঙ্গে
যোগ দিল।

এবং এখন:
ভদ্রমহোদয়গণ!
গোস্তাকি মাফ করবেন
এই গল্প থামানোর জন্য।

কেননা আমি নিজেই চলে যাচ্ছি চিরতরে—
ওই সহজ সরল সুন্দর সাধারণ মানুষের
সঙ্গে চিরকাল থাকার জন্যই।

২).
বইবন্দনা

বই
সুন্দর পেলব
বই
ছোট্ট বন
পাতার
পর পাতা
তোমার কাগজ
মাটি আর বায়ু আর জল আর অগ্নির
গন্ধে মৌ মৌ
বই, তুমি প্রত্যহের
তুমি রাত্রির
তুমি শস্যদানা
তুমি মহাসমুদ্র—

তোমার প্রাচীন পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায়
থাকে ভালুক শিকারি
উৎসবের নীল দীপাবলি
মিসিসিপি অভিমুখে
দ্বীপগুলোতে
ক্যানু—
পরে আসে রাস্তা
রাস্তার পর রাস্তা
আলোকায়ন—
চিন্তার উন্মীলন
বিদ্রোহে টগবগ করা
শহর সব
ফরাসি কবি র‌্যাঁবো
যেন আহত
যেন রক্তভেজা মাছ
কাদায় পরে হাঁসফাঁস করছে
এবং ভ্রাতৃত্বের সৌন্দর্য
মানুষের প্রাসাদ তোলে
পাথরের ওপর পাথর দিয়ে
জড়িয়ে থাকা কষ্টদুঃখ
অটুট হয়ে—
সংহতি—
চোরা গোপন বই
পকেট থেকে পকেটে
তার যাত্রা জারি রাখে
যেন এক গুপ্ত বাতি
যেন একটা লাল জ্বলজ্বলে তারা।

আমরা
অর্থাৎ ভবঘুরে কবিরা
পৃথিবী চষে বেড়িয়েছি, খুঁজেছি তাকে
জীবন আমাদের স্বাগত জানিয়েছে
প্রতিটি দরজায় দরজায়
মাটি-কাদা-জলের সংগ্রামে
যোগ দিয়েছি আমরা।
কিন্তু কী ছিল আমাদের বিজয়?
একটা বই—
একটা বই
মানুষের স্পর্শে আর যোগাযোগে ঠাসা—
নির্জনতাহীন পিরহানে পিরহানে ঠাসা বই
মানুষ আর তার হাতিয়ারে ভরপুর বই—
বই-ই
আমাদের বিজয়।

বই পরিপক্ব হয়
বই পাকা ফলের মতো পড়ে
আছে তার আলো
আছে তার ছায়া
কিন্তু তার পৃষ্ঠাগুলোও তো ছিঁড়ে ফেলা যায়
অথবা রাস্তায় হারিয়ে যায়
মাটিতে সমাধিস্থ হয়।

কবিতার বই
ভোরের আলোর মতো ফোটে
ফিরে আসে তোমার পৃষ্ঠায়
বরফ কিংবা শেওলা ধারণ করার জন্য
যাতে তোমার পায়ের আওয়াজ
কিংবা তোমার চোখ
তাদের চিহ্ন রেখে যেতে পারে—

আরও একবার
আমাদের জন্য
পৃথিবীটাকে বর্ণনা করো
সতেজ পরিষ্কার জলের পৃথিবী
ঝরনার পৃথিবী
লম্বা লম্বা গাছের ঝাড়
বিপরীতমুখী গ্রহ
আর মানুষের বান
নতুন রাস্তায়।
এগোচ্ছে তারা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে
জলের ওপর এগোচ্ছে তারা
সমুদ্রের নগ্ন নির্জনতায়
মানুষ—মানুষ—মানুষেরা
আবিষ্কার করছে
পরম রহস্য:

মানুষেরা ফিরছে
প্রত্যেকের হাতে হাতে বই

বই
বই
বই
বই

ফিরছে শিকারি বাড়িতে—
তারও হাতে বই।

আর চাষা করছে চাষ
তার লাঙল দিয়ে
যার নাম বই।

তাঁর আরও দু'টি কবিতা -
-----------------------------------

"বিশটি প্রেমের কবিতা এবং একটি মরিয়া গান", (১৯২৪ সালে প্রকাশিত),
আমরা সবই বলছি ... থেকে

১).
" আপনি শুনতে এসে আমার কথা,দেখেন
আমার কথা
তারা মাঝে মাঝে পাতলা হয়ে যায়
সমুদ্র সৈকতে সিগলগুলির পায়ের ছাপগুলির মতো।

নেকলেস, মাতাল রটলসনেকে
আঙুরের মতো নরম তোমার হাতের জন্য।

এবং আমি আমার কথাগুলি দূর থেকে দেখি।
আমার চেয়েও বেশি তারা আপনার।
তারা আইভির মতো আমার পুরানো ব্যথায় চড়ে।

তারা এইভাবে স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে আরোহণ করে।
এই রক্তাক্ত গেমটির জন্য আপনিই দোষী।

তারা আমার অন্ধকার লায়ার থেকে পালাচ্ছে।
আপনি সব পূরণ করুন, আপনি সবকিছু পূরণ করুন।

আপনার আগে তারা যে একাকীত্বকে দখল করে রেখেছে,
তারা আপনার চেয়ে আমার দুঃখের প্রতিবেশী অভ্যস্ত।
এখন আমি তাদের বলতে চাই যা আমি আপনাকে বলতে চাই
যাতে আপনি আমার কথা শুনতে চান তেমনই আপনি তাদের শুনতে পান।

ইচ্ছের বাতাস এখনও তাদের টেনে নিয়ে যায়।
স্বপ্নের হারিকেনগুলি এখনও মাঝে মধ্যে এগুলিকে নক করে।
আপনি আমার কণ্ঠে অন্য কণ্ঠস্বর শুনতে পান hear
পুরানো মুখের অশ্রু, পুরনো বিনতির রক্ত।
আমাকে ভালোবাসো, সঙ্গী। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমাকে অনুসরণ কর
আমাকে অনুসরণ করুন, অংশীদার, যে যন্ত্রণার তরঙ্গে।

তবে আমার কথাগুলি আপনার ভালবাসায় দাগ পড়ছে।
আপনি সবকিছু দখল, আপনি সবকিছু দখল।

আমি তাদের সব থেকে একটি অনন্ত নেকলেস তৈরি করছি
আপনার সাদা হাতের জন্য, আঙ্গুরের মতো নরম।

২).
মুঠোবন্দী মন

আরো একটি গোধূলি এসে গেল।
চরাচরজুড়ে নীল রাত নামছে,
অথচ সন্ধ্যায় আমাদের হাত-ধরাধরি হাঁটাই হলো না।

আমি জানালা দিয়ে দেখলাম
অনেক দূরের পাহাড়চূড়ায়
সূর্যাস্তের উৎসব বসেছে।

কখনো কখনো আমার হাতের তালুতে
মুদ্রার মতো
একটুকরো সূর্য পুড়তে থাকে।
মনটা বিষণ্ণ –
তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল
যে মনের কথা তুমি ছাড়া বেশি কে জানে!

তুমি কোথায় ছিলে তখন?
সাথে আর কে ছিল?
কী কথা তাহার সাথে?
যখন মনটা খুব খুব খারাপ থাকে
টের পাই, তুমি অ-নে-ক-দূ-রে,

বলো তো তখন হঠাৎ সব ভালোবাসা আমাকে পেয়ে বসে                                                                                     কেন?

গোধূলি এলে আমার পড়ার বন্ধ বইটা হাত থেকে পিছলে পড়ে,
চোট পাওয়া কুকুরের মতো আমার নীল সোয়েটারটি
আমারই পায়ের কাছে গড়াগড়ি যায়।

প্রতিটি দিন সন্ধ্যা এলে
তুমি সন্ধ্যাকে পেছনে ফেলে
স্মৃতির মূর্তি মুছে ক্রমশ এগোতে থাকো গোধূলি-দিকে।

------------------------------------------------------
[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত। ঋণস্বীকার - অন্যআলো ডট কম। ]