নিকারাগুয়ার কবিতা  (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                 নিকারাগুয়ার কবিতাও ‘স্যান্দিস্তা বিপ্লবে’র আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে উঠেছে !
                 নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট দানিয়েল ওর্তেগার স্ত্রী একদিকে যেমন প্রথিতযশা কবি ছিলেন অন্যদিকে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টও বটে। বিপ্লবের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোন যোগ আছে কিনা জানিনা তবে ‘রোজারিও মারিল্লো’(জন্ম ১৯৫১) কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই কবিতায় সক্রিয় ছিলেন। বিপ্লবে সক্রিয় করার সময়েই কুয়েদ্রা সম্পাদিত নিকারাগুয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় রোজারিও’র লেখা নজর কেড়েছিল। রোজারিও বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন, এখন তিনি নিকারাগুয়ার ফার্স্ট লেডি এবং উপরাষ্ট্রপতি।

রোজারিও মারিল্লো’র কবিতা

আমার বন্ধুরা এবং রাস্তার হৈ হৈ
------------------------------------------------------------

আমার কিছু বন্ধু আছে, তাদের ফেরানো যাবে না। একটা কালো রঙের পাখি যে খুব ভোরে গান গায়। একটা উড়তে থাকা পতাকা দরজার ওপারে আর একটি দ্রুত পায়ে চলে যাওয়া মেয়ে।আর সেই ছেলেটা যার চোখদুটো দেখলেই আমার মনে পড়ে যেত ঝিলের আয়ানার পড়ে থাকা রামধনুর রঙ। তার পা প্রকৃত কাদার প্রলেপে। বাজার খোলে সকাল সকাল, জীবনও। একটা ব্যাগ যেতে চাইছে না। একটা স্লোগান দেয়ালে। মনে হয় অক্ষরগুলো আমার গর্ভ আঁচড়াচ্ছে। এরাই আজ আমার বন্ধু। তারা ভোরের এই আড়ভাঙা ব্যায়ামগুলো সাজাবার চেষ্টা করছে।

যখন তোমার ক্লান্ত চোখদুটো ঘুমোতে যায়
-------------------------------------------------------

যখন তোমার ক্লান্ত চোখদুটো ঘুমোতে যায়
শেষ না হওয়া অপেক্ষা নিয়ে
যখন আরেকবার হাসি ফিরে আসে
আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের মাঝখানে
আমরা সময় নিই
পুরনো ওকে গাছটার পেছনের রাস্তাটায়
যেখানে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, আমাদের যেতে হবে
আমরা মনে করবো আবার সেই আতঙ্কের দিনগুলো
আমরা কথা বলবো সেইসব ঘ্রাণ নিয়ে
একে অপরকে বলবো যুদ্ধের দিনগুলো কিভাবে কাটিয়ে ছিলাম আমরা…

আর্নেস্তো কার্দেনাল
----------------------------

          নিকারাগুয়া তথা লাতিন আমেরিকার স্বনামখ্যাত কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল মার্তিনেজ। তার জন্ম হয় ১৯২৫ সালে। তিনি একজন ধর্মযাজক হয়েও নিকারাগুয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিপ্লবের ধর্মতত্ব বা মুক্তির ধর্মতত্ত্ব (Liberation Theology) অন্যতম জনক। সান্দানিস্তা বিপ্লবের পর কার্দেনাল নিকারাগুয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রকের দায়িত্ব পান। এই মার্কসবাদী ধর্মযাজকের সঙ্গে পোপ দ্বিতীয় জন পলের বিরোধ বাধে, কার্দেনাল যাজক হিসেবে গুরুত্ব হারান। পরে সান্তানিস্তা সরকারের, সরকার পরিচালন ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করে কবি মন্ত্রীত্বও ছেড়ে দেন।

তোতাপাখিরা

আমার বন্ধু মাইকেল হন্ডুরাস সীমান্তের
উত্তর সোমোতোর একজন সেনা অফিসার,
তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি কিছু
বে-আইনি তোতার খোঁজ পেয়েছিলেন
যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চোরাচালান হবার জন্য
অপেক্ষা করছিল, সেখানে গিয়ে ইংরিজি বুলি শেখানো হবে।
*
সেখানে ১৮৬টি তোতাপাখি ছিল
যার মধ্যে ৪৭টি তখনই খাঁচার ভেতর মারা গিয়েছিল।
যেখান থেকে তাদের ধরা হয়েছিল সেখানে
তিনি ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসছিলেন
কিন্তু সেই লরি এসে যেই প্রবেশ করল সেই সমতলে
*
ঐ পর্বতমালার কাছে, যেখানে ছিল তোতাদের বাসা
(সমতলভূমির পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিরাট পর্বতসারি)
পাখিগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠল, শুরু করল ডানা ঝাপটাতে
ধাক্কা দিতে লাগলো খাঁচার গায়ে।
*
যখন খাঁচাগুলো খুলে গেল
তারা ঠিক যেন তীর বৃষ্টির মতো ছুটে গেল
সোজা তাদের পাহাড়গুলোর দিকে।
*
আমার মনে হয় বিপ্লব ঠিক এই কাজটাই করে :
সে খাঁচা থেকে আমাদের মুক্ত করে
যেখানে ওরা আমাদের ইংরিজি বুলি শেখাতে ফাঁদবন্দি করেছিল
সেখান থেকে সে আমাদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনে
যেখান থেকে আমাদের উৎখাত করা হয়েছিল,
তাদের সবুজ পাহাড়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয় তাদেরই সবুজ তোতাসাথীরা।
*
কিন্তু সেখানে ছিল আরো ৪৭টি, যারা নিহত হয়েছে।

গিয়াকোন্দা বেল্লি
--------------------------

             উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবান পরিবার থেকে আসা নিকারাগুয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী গিয়াকোন্দা বেল্লি । ১৯৪৮ সালে নিকারাগুয়ার মানাগুয়ায় বেল্লির জন্ম হয়। ১৯৭০ সালে সামোজা স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে  নিকারাগুয়ার সান্দানিস্তা ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে শুরু হওয়ায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ  করেন বেল্লি। বিপ্লবের পরেও তিনি একজন সাহসী গণতান্ত্রিক কন্ঠ হিসেবে সমালোচনা করেছেন সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপের।

হরতাল

আমি একটা হরতাল চাই যেখানে আমরা কেউ ঘরে থাকব না।
এ হবে কাঁধ, মাথা, চুলের হরতাল,
শরীরে শরীরে জন্ম নেবে যে হরতাল।
আমি একটা হরতাল চাই
শ্রমিকের        ঘুঘুপাখির
চালকের        ফুলের
কারিগরের     শিশুর
চিকিৎসকের   মায়ের

আমি একটা বিরাট হরতাল চাই
যাতে এমনকি থাকবে প্রেমও
একটি হরতাল যাতে সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে
ঘড়ি                   কারখানা
নার্সারি      ইউনিভারসিটি
বাস                    হাসপাতাল
রাজপথ              বন্দর
এ হবে চোখের, হাতের, চুম্বনেরও হরতাল,
এমন একটি হরতাল যেখানে নিষিদ্ধ থাকবে শ্বাস চলাচল

একটি হরতাল যেখানে নীরবতার জন্ম হবে
স্বৈরাচারীর পলায়নরত পায়ের শব্দ শোনার জন্য।

জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা
-----------------------------------------

নিকারাগুয়ার স্পেনীয়-রোমান ধর্মযাজক, কবি  জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানার জন্ম ১৯৪১ সালে। তিনি গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র জনসাধারণের ভেতরে কাজ করতে গিয়ে অবর্ণনীয় শোষণ অত্যাচার দেখে, প্রচন্ড সমালোচক হয়ে ওঠেন সে সবের। লিবারেশন থিয়োলজিতে বিশ্বাসী লাভিয়ানাকে সামোজার ন্যাশানাল গার্ড তাকে দু'বার গোপনে হত্যার চেষ্টা চালায়। তিনি দেশত্যাগ করে কোস্টারিকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হয় দেশত্যাগী সান্দানিস্তা ন্যাশানাল ফ্রন্টের বিপ্লবীদের সঙ্গে। তিনি তাঁদের চিন্তা ও আদর্শের সাথে নিজের ভাবনার মিল খুঁজে পান এবং FLSN এ যোগ দেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালে কোস্টারিকা সীমান্তে সান্দানিস্তা গেরিলা বাহিনীর ইউনিটে তিনি ছিলেন,যেটি পরে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়,সেখানে নিহত হন জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা।
              বিপ্লবের পরে নিকারাগুয়ার খ্যাতনামা কবি আর্নেস্তো কার্দেনালের তত্বাবধানে তাঁর লেখাপত্র ও কবিতাগুলি সংকলিত হয়।

সরোবরে ধ্যান

নদীতীরে ধ্যানস্থ এই তোমার থেকে আমি অনেক দূরে
সুরচ্যুত স্বরলিপি বাঁধছি এখন আবার সুরে সুরে
অবিরাম ঢেউ বুনছি নিবিড় শব্দ পুরে ছন্দে এবং ভাষায়
যেমন ছিল সেই সে লিপি পেলাম ফেরত তরঙ্গরা আসায়
সরোবর ফের পাঠ বলে যায়
জল নাচিয়ে ফেনায় ফেনায়
আবার বলে এবং আবার কন্ঠে তুমুল সেই অবিরাম নাম
মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তির সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!

-----------------------------------------------------
[তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত]
কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার
(১). অনুবাদক - মৃন্ময় চক্রবর্তী। (২). স্বপন রায়।
------------------------------------------------------