নিকারাগুয়ার কবিতা  (প্রথম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


              রাজনীতি আর নিসর্গ’- প্রকৃতির মিশ্রিত অভিঘাতের কারণে, তুমুল পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে লেখা হয়েছে নিকারাগুয়ার কবিতা। ‘কবিদের দেশ’ বলা হয় নিকারাগুয়াকে।
            নিকারাগুয়া উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই আমেরিকার হস্তক্ষেপে বারবার আলোড়িত হয়েছে । জলপথের অধিকার কায়েম করতেই আমেরিকা প্রাথমিকভাবে এই আক্রমণগুলো করত নিকারাগুয়াকে। পরে ‘পানামা ক্যানেল’-য়ের ক্ষমতা নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য তাদের নৌ-সেনারা ১৯১২ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত নিকারাগুয়াকে দখলে রাখে।
           ১৯২৭ সালে ‘অগুস্তো সিজার স্যান্ডিনো’ এই দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলে আক্রমণ শুরু করে দেয়।

           নিকারাগুয়ার কবিতায় প্রবাদপ্রতিম কবি ‘রুবেন দারিও’(১৮৬৭-১৯১৬) অনেক আগে থেকেই এই দখলদারীকে অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি নিজের এলাকায় কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ষোলো বছর হতে না হতেই সারা দেশে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কবিতায় স্প্যানিশের সাঙ্গীতিক মূর্ছনার প্রয়োগ ছিল। আর ছিল ভাষাগত অস্তিত্বের সঙ্কটের সঙ্গে রাজনৈতিক সঙ্কটের মিথষ্ক্রিয়া।

            ‘রুবেন দারিও’কে বলা হয় নিকারাগুয়ার আধুনিক কবিতার জনক।

              লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর মতই নানা রকমের জটিল সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিকারাগুয়া গড়ে উঠেছে। ১২০০০ খৃঃপূঃ’-র সময়ে ‘পেলিও-আমেরিকান’রা নিকারাগুয়ায় বসবাস করতে শুরু করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘মেসো আমেরিকান’ সংস্কৃতিই (আজটেক ও মায়া সভ্যতা) মূলধারা হয়ে ওঠে নিকারাগুয়ার। ভাষাগতভাবে দুটি ‘ডায়লেক্ট’ ওই সময় প্রধান ছিল।
            ফরাসি শিল্প-সাহিত্যপ্রভাবিত ‘মদের্নিসমো’ নামের এক আধুনিক কাব্য-ধারার গোড়াপত্তন ঘটে ১৮৮৫ সালে নিকারাগুয়ার রুবেন দারিও, কিউবার হোসে মার্তি প্রমুখ কবির নেতৃত্বে। আবার এ-ধারার বিপরীতে একটি শক্তিশালী সংরক্ষণবাদী ধারারও আবির্ভাব ঘটে, যারা স্বদেশ, দেশের মানুষ ও ঐতিহ্যকে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন। ব্যাপকার্থে কাব্য-সাহিত্যের এই আন্তর্জাতিকতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী ধারার বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে, বাস্তবতায় আবার জন্ম নিল এক প্রগাঢ় নিরীক্ষাভিত্তিক 'avant grade' বা 'অগ্রগামী সাহিত্য', যা পূর্বোক্ত দু'ধারার সংশ্লেষণও (Synthesis) বটে।
           ‘মদের্নিসমো’-পরবর্তী বিশ শতকের পাঁচ বিখ্যাত কবি হলেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, হোর্হে লুইস বোর্হেস, কার্লোস দ্রামন্দ দে আন্দ্রাদে, পাবলো নেরুদা এবং অক্টাভিও পাস।
            তাঁদের মধ্যে মিস্ত্রাল, নেরুদা ও অক্টাভিও পাস নোবেল পুরুস্কার  পেয়েছেন। তাঁদের পাশাপাশি আরও অনেকের কবিতা আজ বিশ্ব-সাহিত্যের অঙ্গীভূত।।
             ১৫০২ সালে কলম্বাসের নেতৃত্বে ‘ম্যানগুয়ে’ আর ‘নৌহাট’ প্রথম স্পেনিয় বাহিনী নিকারাগুয়ায় অভিযান চালায়। তবে বছর কুড়ি পরে গঞ্জালেস দ্যাভিলার নেতৃত্বে সফল ঔপনিবেশিক অভিযান শুরু হয়।
              ১৫২৪ সালে ফ্রান্সিস্কো হারান্‌ডেজ দ্য করডোবা প্রথম স্প্যানিশ সেটেলমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন ‘গ্রানাডা’। এরপরের প্রাউ তিনশো বছরের ইতিহাস হল লুঠ, শোষণ, অত্যাচার, প্রতিরোধ আর ভাষাগত এবং জাতিগত সংকরায়ন (hybridization) -য়ের ইতিহাস। স্প্যানিশ এবং স্থানীয় জাতিতত্ত্বমূলক (ethnic) সৃষ্টি হয়েছে ‘মেসিৎজো’ জাতিসত্ত্বার, যারা এখনকার নিকারাগুয়ার প্রধান ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে ।
                এই সামাজিক রূপান্তরের ভেতরেই বিবর্তিত হয়েছে নিকারাগুয়ার সাহিত্য। ‘উত্তর কলোম্বিয়ান’ যুগের প্রথম লিখিত সাহিত্য হল ‘এল গুয়েগুয়েনেজ’।
          তার আগে গল্প আর পদ্যই প্রচলিত ছিল ‘মৌখিক’ ভাবে।
             নিকারাগুয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৮২১ সালে। ‘রুবেন দারিও’র প্রস্তাবনায় ‘মর্ডানিজম’ ধারার লেখালিখি শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। সঙ্গে ছিলেন, ‘সালমন ডি লা সিলভা’, ‘কারলোস মার্টিনেজ রিভাস’ প্রমুখ কবিরা।
              মূলতঃ ‘রোমান্টিসিজম’, ‘পারনাস্‌সিয়ানিজম’ এবং ‘সিম্বলিজম’ থেকে অনুপ্রাণিত ছিল ‘মর্ডানিজোম’। এই তিনধারাকে মিলিয়েই রুবেন দারিওর কবিতা লেখা হয়েছে। আধুনিকতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আর ‘এলিটিসিজম’ রুবেন দারিওর কবিতাকে অনন্য করে তুলেছিল। এবার আসুন পড়ি ‘রুবেন দারিও’র কিছু কবিতা -

অমোঘ নিয়তি

বৃক্ষেরা সুখী কারণ তারা নিশ্চেতন বললেই চলে
কঠিন শিলা সংবেদনহীন বলে আরও বেশি সুখী
বেঁচে থাকার মতো এত বিপুল যন্ত্রণা কিছুতে নেই
সজ্ঞান জীবনের মতো কোনও বোঝা এত ভারী নয়।

কী যে হবো জানা নেই, জ্ঞান নেই, এটা সেটা ত্রুটি
যা আছি তাতেই ভয়, যা হবে আতংক তার…
কালকেই পটল তোলার সুনিশ্চিত বিভীষিকা,
আজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্ধকার পার হওয়া
পার হওয়া যা জানি না, যা সন্দেহও করি না
এবং যে মাংস শীতল আঙুরগুচ্ছের সাথে আমাদের টানে,
যে কবর শেষকৃত্যের শুচিজলের অপেক্ষায় থাকে
এবং যে আমরা জানি না কোথায় যাব
এবং জানি না কোথা থেকে আমরা এসেছি!…

স্পেনের ব্যাগপাইপ

ব্যাগপাইপ ওই স্পেনের, গান শোনাতেই পারে
মধুরতম গান আমাদের বাসন্তিকা গান
খুশির আবহাওয়াতে শুরু, যন্ত্রণাতে শেষ
তোমার গানে তোমারই সব আমরা কোথাও নেই

বললে, এটা বর্ষা, গাও বৃষ্টি একে একে
আমি তখন প্রবল খরায় লিখছি দাহ্যতাকে
সোলোমনের কথায় আছে, পড়োনি ব্যাগপাইপ
যে ঋতুরও বহু প্রকার আছে, আলাদা সবিশেষ

গাছের ঋতু, বপন ঋতু, ঋতু কর্ষণের
রোঁয়ার ঋতু, ফসল-ঋতু, হাসি ও কান্নার
ভিন্ন ঋতুর গানে গানে আশা নিরাশার
মাঝেই আসে প্রেমের ঋতু, ঋতু সঙ্গমের
জন্ম আসে, প্রতি ঋতু্র প্রতিটি জন্মদিনে…

হেমন্তে

আমি জানি,অনেকেই বলে থাকে, সেই মধুরতম গান
সে গায় না কেন? তার প্রশাখাশিহরে বুনো মর্মর আর
শোনা যায়না কেন? তারা কিন্তু একটি ঘন্টার শ্রম বা
এক মিনিটের কাজে হয়ে ওঠা ওই গানের বিস্ময়
না দেখেই এসব বলছে

আমার বয়স অনেক।যখন ছোট ছিলাম, বাতাস ছুঁলেই
বেজে উঠতাম আমি, তারুন্যে আনন্দধারা বইতো, ছুঁলেই
গাছের শব্দেও বয়েস ছাপ ফেলে যায়, সে চায় গাইতে, আর তার গানে
থেকে থেকে ঝড় তোলে ‘হারিকেনে—এর ঘূর্ণী!

রুজভেল্টের প্রতি

বাইবেলের উচ্চারণ আর হুইটম্যানের কবিতা নিয়ে
আমরা তোমার কাছে পৌঁছব, শিকারী!
পুরনো আর নতুন,সহজ এবং জটিল কিছুটা ওয়াশিংটনের অংশ নিয়ে
কিছুটা নিমরডের, আমরা পৌঁছব!
তুমি, তুমিই আমেরিকা
ভবিষ্যতের আক্রমণকারী আর সেই গ্রাম্য আমেরিকান যার রক্ত ‘ইণ্ডিয়ান’-এর
যে যীশুবাবার পুজো করে, তারাই আমরা
আমরা কথা বলি
স্প্যানিশে
তুমি গর্বিত প্রতীক, আমেরিকার! তুমি সংস্কৃতি বোঝো, বুদ্ধিমান
টলস্টয়ের বিরোধীতা করো, চালাক খুব, তুমি ঘোড়া বা বাঘ
কাউকে রেয়াত করোনা, তুমি প্রতীক হে!
হে যুবরাজ আলজেন্দ্রো নেবুচান্দনেজ্জার (তুমি শক্তি আর স্ফূর্তির অধ্যাপক, পাগল উবাচ), তুমি জীবনকে ভাবো আগুন
প্রগতিকে বিস্ফোরণ
আর বুলেট রেখে বলো, সভ্যতা রাখলাম
না
আমেরিকা বড়, আমেরিকার জোরও বড়
একটু কাঁপলেই ভূমিকম্প হয়
না, আন্দেজের শিরদাঁড়ায় তখন গর্জন শুরু হয় সিংহে
সেই গর্জন শোনো, হে প্রতীক, ভুলে যেওনা হিউগো গ্রান্টকে বলেছিলেন, তুমি ধনী, অগণিত তারার সাম্রজ্য তোমার (সূর্য আর্জেন্টিনায় ওঠে আর তারা চিলিতে), তুমি ধনী, মনে করো হারকিউলিস আর বৈদ্যুতিক আলোর সংযোগ, যে আলোয় লিবার্টি মূর্তি হল
হাতে জ্বলল ‘নিউ-ইয়র্ক’-এর মশাল
সবই আমাদের (অংশ)।
                ১৯১৬ সালে ‘রুবেন দারিও’ মারা যান।