মির্জা গালিব (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


(গল্পের আগের গল্প)


       জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষ ঠাঁই নিয়েছে ভারতের মাটিতে। আরব, আফগান, তুর্কি এবং মোঙ্গল- তাদের অনেকেই আর ফিরতে পারেননি নিজেদের দেশে।
      মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে এমন এক ভাগ্যান্বেষী তুর্কি সৈনিক আগমন করলেন কুক্বান বেগ খান নামে। কিছুদিন লাহোরে বসবাস করে দিল্লিতে গিয়ে চাকুরি নেন সম্রাট শাহ আলমের দরবারে। সেখানেও মন টিকল না তাঁর। তিনি চলে গেলেন জয়পুরে। সেখানে মহারাজার অধীনে কাজ নেন। স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন আগ্রায়। দুই ছেলের মধ্যে নাসরুল্লাহ বেগ খান চাকরি জুটিয়ে নেন মারাঠা শিবিরে। অন্য ছেলে আবদুল্লাহ বেগ খান অতটা ভাগ্যবান ছিলেন না। বহু দরবার ঘুরে ফিরে আলোয়ার মহারাও বক্তাওর সিং- এর সেনাধিনায়ক হিসাবে যোগ দেন তিনি। কিন্তু সেখানেও থাকা হয়ে উঠেনি তাঁর।
        ১৮০২ সালে মৃত্যু বরণ করলেন বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে।
     ইতিমধ্যে দুই পুত্র এবং এক কন্যা রেখে যান আবদুল্লাহ বেগ। বড় ছেলের নাম আসাদুল্লাহ বেগ খান ; পরবর্তী সময়ে যিনি মির্জা গালিব নামে বিখ্যাত হন। ১৭৯৭ সালের ২৭শে ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া গালিব বেড়ে উঠেছিলেন চাচা নাসরুল্লাহ খানের তত্ত্বাবধানে। হাতির পিঠ থেকে পড়ে ১৮০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন নাসরুল্লাহ। নবাবের প্রচেষ্টায় লর্ড লেক মৃতের পরিবারের জন্য ভাতা বরাদ্দ দেন। গালিবের ভাগ্যে জুটেছিল বাৎসরিক ৭৫০ টাকা। তাও পরের দিকে সে ভাতাও পারিবারিক টানাপোড়েনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ‘গালিবের মা’ যতদিন বেঁচেছিলেন ; অর্থের কিছুটা পেতেন। জীবনের উপলব্ধি নিয়েই পরে তিনি লিখেছেন-

“বাজিচায়ে আতফাল হ্যায় দুনিয়া মেরে আগে,
হোতা হ্যায় সব রোজ তামাশা মেরে আগে।”
(আমার সামনে পৃথিবীটা যেন বাচ্চাদের খেলার মাঠ, প্রতিটা রাত্রি আর দিনে কেবল তামাশাই ঘটে যাচ্ছে।)
  
       প্রাথমিক দিনগুলো আগ্রায় এক মাদ্রাসার প্রসিদ্ধ শিক্ষক মুহম্মদ মুয়াজুমের ছাত্র ছিলেন মির্জা গালিব। তৎকালীন মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় আরবি ভাষা ও ধর্মকে গুরুত্ব দেয়া হতো। সরকারি ভাষা হবার দৌলতে পড়তে হতো ফার্সি। শীঘ্রই আবদুস সামাদ নামক জনৈক ব্যক্তির জ্ঞান এবং চিন্তা তাকে প্রভাবিত করে। ভদ্রলোক প্রথম জীবনে জরাথুস্ত্রবাদী থাকলেও পড়াশোনা করে ইসলামে দীক্ষা নেন। আরবি-ফারসি ভাষা এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়।
গালিব দুই বছর (১৮১০-১২) তাকে নিজের পরিবারে রেখে জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী জীবনেও তার সাথে গালিবের পত্রালাপে যোগাযোগ ছিল।

“কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম আসল্ মে দুনো এক হ্যায়,
মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”
(জীবনের মেয়াদ আর বিষাদের বন্দীত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, মৃত্যুর আগেই মানুষ বিষাদ থেকে মুক্তি পাবে কেন?

এর মধ্যে ১৮১০ সালের আগস্ট মাসে ইলাহি বক্স খানের কন্যাকে বিয়ে করেন গালিব। ইলাহি বক্স ছিলেন ফিরোজপুরের ঝিরকা এবং লোহারুর নবাব আহমদ বক্স খানের ভাই। খুব সম্ভবত তাদের অনুরোধেই আগ্রা ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন।
       আগ্রার মকতবে থাকতেই শায়েরি লেখায় হাত পাকে গালিবের। প্রথম দিকে ফার্সিতে লেখলেও দ্রুতই উর্দুকে বেছে নেন ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে। ততদিনে শিক্ষিত সমাজে উর্দুর ব্যবহার এবং মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবদুস সামাদের মাধ্যমে পরিচিত হন ফারসি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বেদিল, বুখারী, আসির, রুমি, জামিদের সাথে। গালিব প্রথমদিকে তাদের ব্যর্থ অনুকরণ করেন। লেখাগুলো তাই তখনও ঠিক কবিতা হয়ে ওঠেনি তাঁর। হতাশ না হয়ে এগিয়ে গিয়েছেন গালিব নিজের পথ ধরে ধীরে ধীরে।
    নবাব হুসামুদ্দৌলা গালিবের কবিতার ভক্ত ছিলেন। একবার কিছু গজল সাথে নিয়ে সেই সময়ের বিখ্যাত কবি মীরকে দেখান হুসাম। লক্ষ্ণৌতে বসে উদীয়মান কবির লেখা দেখে মীর আক্ষেপ করে বলেছিল, 'একটা ভাল গুরু পেলে বালকটির বড় কবি হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে ; আর না পেলে অসার কথামালা গেঁথেই প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাবে তার।
           মীরের অবস্থান তখন উর্দু কবিতায় সব থেকে উঁচুতে আর তার মৃত্যুর সময় গালিবের বয়স মাত্র তেরো বছর। ঠিক সেই বয়সের লেখা কবিতা হুসামুদ্দৌলার মাধ্যমে মীরকে দেখানোর ঘটনাই প্রমাণ দেয় গালিবের সম্ভাবনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গালিব কোনো প্রকার গুরুর ছায়ায় না দাঁড়িয়েই স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।
    গালিবের অনেক লেখাতেই তকী মীরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে।
       গালিবের চিঠিতে 'ডোমনি' সম্বোধনে এক নারীকে দেখা যায়। শব্দটির অর্থ একাধারে গায়িকা ও নর্তকী হলেও তিনি ছিলেন উচ্চবংশীয়া এক সম্ভ্রান্ত মহিলা। কবির শোকগীতি দেখে সহজেই অনুমেয়, সেই প্রেয়সী খুব অল্প বয়সেই মারা যান।

   “ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে, কলঙ্ক থেকে বাঁচতে
হায়, তোমার ধুলার ঘোমটা পরার ব্যাপারটা বড়ই বাড়াবাড়ি নয় কি!”
     খুব সম্ভবত গালিবের প্রণয়ণী লোকনিন্দার ভয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তাই, পরবর্তী লেখাগুলোতে বিরহ এক প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠে ছিল। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে তখনকার জনগণের মদ-জুয়ার মতো কিছু কুস্বভাব থাকতো ; গালিবেরও ছিল।
       আগ্রা থেকে মা এবং দিল্লি থেকে আহমদ বক্স খান তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু আহমদ বক্স নবাবী থেকে ইস্তফা দিলে গালিবের অবস্থা হয়ে উঠলো শোচনীয়। হু হু করে বেড়ে উঠতে থাকলো ধার-দেনা।