মির্জা গালিব (ষষ্ঠ পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


(গালিবের চিন্তাধারা)

         মির্জা গালিব ছিলেন ফার্সি সাহিত্যের ক্লাসিক কবি এবং উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ। এতদিন কবিরা প্রায়ই জীবন ও বাস্তবতার বাইরে বসবাস করতেন। গালিবের কবিতায় ফুটে উঠলো জীবনের সুর, বাস্তবতার আঘাত, নিয়তি এবং চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ।  
         এজন্য জনপ্রিয়তা এতটাই উচ্চতায় পৌঁছালো যে, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে চারবার পুনর্মুদ্রণ করতে হয় দিওয়ান।  
          আচারজাত ধর্মের থেকে অন্তরজাত ধর্মের দিকে গালিবের মনোযোগ ছিল বেশি। এজন্য সমকালীন ধর্মতত্ত্ববিদদের অনেকেরই কোপানলে পড়তে হয়েছে তাকে বারবার। প্রতিষ্ঠিত ধর্মচর্চার প্রতি গালিবের কটাক্ষ ফুটে উঠেছে-
“কাবা কিস মুহসে যাওগে গালিব,
শরম তোমকো মাগার নেহি আতি।”
(কোন দিক ঘুরে তুমি কাবায় যাবে গালিব; যখন তুমি লজ্জিত আর অনুতপ্ত নও?)

     আত্মশুদ্ধি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তার ধর্মচিন্তা। স্মরণ করা যেতে পারে, গালিব পারস্য ও ভারতের সুফিবাদ এবং ক্লাসিক যুগের ফারসি কবিতার সাথে সুপরিচিত ছিলেন।  

“উমর ভার গালিব ওহি গালতি করতা রাহা
ধুল চেহরে পর থি ওর আয়না সাফ করতা রাহা।”
(জীবনটা ভরে গালিব একই ভুল করে গেছে। ধুলো ছিলো মুখে আর সে বারবার পরিষ্কার করেছে আয়না।)

       আত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যকার সম্পর্ক গালিবের চোখে ধরা দিয়েছে অন্যভাবে।

“না থা কুচ তো খোদা থা, কুচ না হোতা তো খোদা হোতা
ডুবায় মুজকো হুনে নে, না হোতা ম্যায় তো কিয়া হোতা?”
( যখন কিছুই ছিলো না, খোদা ছিলেন। যদি কিছু নাও হতো, খোদা থাকতেন; আমার অস্তিত্বই আমাকে ডুবিয়েছে, আমি না থাকলে কি এমন হতো?)

        জীবন, পৃথিবী, প্রেম, ধর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি বিষয়কে গালিব কবিতায় রূপান্তরিত করে গেছেন। অজস্র অনুভূতি তার ছন্দে বাহিত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। পথ দেখিয়েছেন পরবর্তী অনেক কবিকেই। গালিবকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়েছে নানা গবেষণা ; তৈরি হয়েছে উপন্যাস, সিনেমা এবং টিভি সিরিজ। উর্দুর গণ্ডি ছাপিয়ে দিওয়ান অনূদিত হয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু ভাষায়। এইজন্যই হয়তো ‘মুহাসিনে কালামে গালিব’ গ্রন্থের প্রথম লাইনেই নাসিরি বলেছেন -
“হিন্দুস্তানে দু'টি আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে; একটি পবিত্র বেদ এবং অন্যটি দিওয়ানে গালিব”।

        কাব্যবিশারদ জাভেদ ইকবাল বলতে পেরেছেন আরো এক ধাপ সামনে গিয়ে।
   "কাব্য ‍যদি হয় ইমান, তবে গালিবের অনুসারী না হওয়ার অর্থ হচ্ছে কাফের হওয়া”। (জান-এ- গালিব, পৃষ্ঠা- ১৫)