মির্জা গালিব  (পঞ্চম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


(দ্বিতীয় জীবন)


                  মোঘল দরবারে গালিবের ঠাঁই হয়নি বেশ কিছু কারণে। তাই নিজে নিজেই পথ চলতে উদ্যমী হলেন। বন্ধুর পরামর্শে ১৮৪১ সালে ১১০০টি শায়ের নিয়ে প্রকাশ করেন প্রথম দিওয়ান। দিল্লি কলেজের ফার্সি ভাষাশিক্ষার চাকুরিও চলে এসেছিল তার হাতে প্রায়। দিল্লি কলেজের পরিদর্শক ছিলেন জেমস্ থমসন। ফার্সি ভাষায় গালিবের দক্ষতা শুনে তার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলো পড়ানোর জন্য। গালিবও প্রস্তাব মেনে থমসনের বাড়ি এলেন। অপেক্ষা করলেন অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে ভেতরে ডেকে নেবার জন্য।
         কেউ এলো না, গালিবও গেলেন না ভেতরে। কিছুক্ষণ পরে থমসন নিজে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ভেতরে না যাবার কারণ। তিনি জানালেন, আগে প্রতিবারই তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে ; আজ এমন ব্যতিক্রম হবার কারণ কী? থমসন স্পষ্ট করে দিলেন বিষয়টি। আগে প্রতিবার গালিব ছিলেন দরবারের অতিথি, আর এখন তিনি একজন অধীনস্ত চাকুরে মাত্র। শুনে সাথে সাথেই চাকুরি না নিয়ে ফিরে আসেন মির্জা গালিব। এই ঘটনাই নির্ধারণ করে দেয় কবির আত্মসম্মান বোধ।

“কাহো কিসসে ম্যাঁয় কি কিয়া হ্যায় শাবে গাম বুরি বালা হ্যায়,
মুজে কিয়া বুরা থা মারনা আগার এক বার হোতা?”
(এই নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ন রাতের অভিযোগ আমি কার কাছে করব? প্রতি সন্ধ্যায় মরার চেয়ে একবারে মৃত্যুটাই কি শ্রেয় ছিল না?)

               অর্থকষ্টে গালিব তখন জর্জরিত। তাই যেন আরও বেশি করে জড়িয়ে গেলেন জুয়ার নেশায়। এই অপরাধেই গ্রেফতার হয়ে তিনমাসের জন্য ঢুকলেন জেলে। সেখানেও প্রচলিত আছে এক গল্প। জেলে থাকার সময় একদিন এক যুবককে কাঁদতে দেখেন গালিব। কারণ জানতে চাইলে যুবক উত্তর দেয়, তিনদিনের জেল হয়েছে। গালিব বিস্মিত হয়, মাত্র তিনদিনের জন্য কান্না! ফোঁপাতে ফোঁপাতে যুবক জানায়, তার বিয়ে হবার কথা ছিল ; বিয়েটা ভেঙে গেলো। গালিবের উত্তর দিলেন, রসাত্মক -
' বাহ! মাত্র তিনদিনের জেলের বিনিময়ে সারাজীবনের জেল খাটা থেকে বেঁচে গেলে। তোমার তো বরং আনন্দ করার কথা। '

               জেল থেকে বের হলে সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন মৌলানা নাসিরুদ্দিন। সম্রাটের কাছে সুপারিশ করে দরবারী ইতিহাসকারের কাজ দেয়া হয়।বাহাদুর শাহের দরবারে লেখার কাজ নেন গালিব।  বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালো হয়ে ওঠে। ১৮৫০ সালে বাদশাহ তাকে ফার্সি ভাষায় তৈমুর বংশের ইতিহাস রচনার ভার দিয়ে বছরে ছ'শো টাকা বরাদ্দ করে দেন। হঠাৎ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে শুরু করে তাঁর।
মির্জা ফখরুদ্দীন এবং ওয়াজেদ আলি শাহ ভাতার ব্যবস্থা করলেন গালিবের জন্য।
কিন্তু এই স্বাচ্ছন্দ্য বেশীদিন স্থায়ী হয়নি।
         ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন গোটা গল্পটা বদলে দিল। গালিব সরাসরি কোন পক্ষকে সমর্থন না করে  অপেক্ষা করে থাকলেন অনেক আশায়।

“হাজারো খাওয়ায়িশে অ্যাইসি কি হার খাওয়ায়িশ পে দাম নিকলে,
বহুত নিকলে মিরে আরমা লেকিন ফিরভি কাম নিকলে।
(হাজার আকুল আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটাই পীড়িত করে সমান ভাবে। অনেকগুলোই পূরণ হয়ে গেছে, তারপরেও যেন পর্যাপ্ত হয়নি।)

                  সিপাহি বিদ্রোহের পর গালিবের আশ্রয়স্থল হয় রামপুরের নবাব ইউসুফ আলি খানের কাছে। বরাদ্দ হয় মাসিক বৃত্তি। সিপাহি বিদ্রোহের অশান্ত সময়ে টুকে রাখা নোটগুলো গুছিয়ে নিয়ে প্রকাশ করেন দাস্তাম্বু। সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস চর্চার জন্য বইটি অনন্য দলিল।
সিপাহি বিদ্রোহ বদলে দেয় গোটা ভারতের ভবিষ্যৎ।
              ব্রিটিশদের কোপদৃষ্টিতে পড়ার ভয়েই হোক কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা পাবার জন্যই হোক, ব্রিটিশদের তোষামোদির চেষ্টা তাকে তার পূর্বতন সুযোগের অনেকটাই ফিরিয়ে দেয়।    
                 ১৮৬০ সালে পুনরায় চালু হয় পেনশন। ১৮৬৩ সাল থেকে যোগ দেন দরবারে। অবস্থা আরো ভালো হতে পারত। কিন্তু ব্রিটিশ তদন্তে সিদ্ধান্ত আসে, গালিব ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত না থাকলেও বিরোধীদের প্রতি তাঁর গোপন সহানুভূতি ছিল। আসলে এতে তার দোষ নেই ; কারণ তিনি ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন-

“কিতনা খাওফ হোতা হ্যায় শাম কে আন্ধারো মে
পুছ উন পারিন্দোছে জিনকো ঘর নেহি হোতে।”
(সন্ধ্যার অন্ধকার কতটা ভয়ঙ্কর, তা সেই পাখিকে জিজ্ঞাসা করো; যার কোনো ঘর নেই।)  

                      শরীর ভেঙে পড়তে থাকে তাঁর ধীরে ধীরে। তারপরও রামপুর রাজ্যের সভাকবির ভূমিকা পালন করে গেছেন গালিব। ১৮৬৬ সালের দিকে আবার ফেরেন দিল্লি। ১৮৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারান তিনি। আর ফেরানো যায়নি তাকে। পরদিন ১৫ই ফেব্রুয়ারি দুপুরের পরই মৃত্যুবরণ করেন মির্জা গালিব। দিল্লিতেই তাকে সমাহিত করা হয় বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সমাধির কাছে।