লিমেরিক ও এডোয়ার্ড লিয়র
শংকর ব্রহ্ম


                    লিমেরিক (Limerick) হল এক ধরনের ছড়া , যা  পাঁটি লাইনের হয়। এগুলি সাধারণতঃ হাস্যরসাত্মক,বিদ্রুপাত্মক, তীর্যক ধরনের হয়।  মিলের বিন্যাস: ক ক খ খ ক। ৩য় ও ৪র্থ পঙ্‌ক্তি অন্যগুলোর চেয়ে মাপে ছোট হয়।

                        এর নামকরণ লিমেরিক কেন হল?
লিমেরিক আসলে একটি জায়গার নাম,
এর নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে, সে ইতিহাস লিমেরিকের মতই অদ্ভূত।
লিমেরিক আয়ারল্যান্ডের একটি জায়গার নাম, ফ্রান্সের সৈন্যদলের আইরিশ ব্রিগেডিয়াররা ওই স্থানে (লিমেরিকে) অবস্থান কালে এই রকম ছড়ার গান গাইত, সেখানে ধুয়ার মত শেষ লাইনে থাকত এই কথাটি
“ Let us come up to Limerick”.
সুর করে কোরাসের মাধ্যমে গাইত তা'রা। কোন অজানা কবির হাত ধরে প্রথম এই ধরণের গান চালু হয়েছিল তা কেউ জানে না। লিমেরিকের এই ধরণটার অনুকরণে সৈন্যরা নিজেরাই মুখে মুখে ছড়া তৈরী করে নিজেরাই সে গান গাইত।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে, যে যার বাড়ি ফিরে গিয়ে সেইসব গান শোনাত তাদের বংশধরদের।
লিমেরিক(আয়ারল্যান্ডের একটি জায়গা) থেকে আমদানি বলে এবং শেষে ধুয়ার মতো এই কথাটি থাকার ফলে “Let us come to Limerick”  লিমেরিক(“Limerick”) বলে ছড়াগুলোর নাম হয়ে গেল ।

পাঁচ লাইনের এই ধরণের ছড়া বহুযুগ ধরেই ছিল। যেমন -

"Hickory dickory dock
The mouse ran up the clock
The clock struck one
The mouse ran down
Hickory dickory dock"

( হিকরি ডিকরি ডক
ইঁদুরটি ঘড়িতে দৌড়ায়
ঘড়িটি একটা ধাক্কা মারলে
ইঁদুরটি দৌড়ে গেল
হিকরি ডিকরি ডক)

             সাহিত্যে প্রথম এর অবতাড়না করেন 'এডোয়ার্ড লিয়র' । লিয়র ছিলেন সে রকম একজন মানুষ যার মজার উৎসটুকু ছিল তার বেদনাবোধ সঞ্জাত। নিজের ব্যথা-বেদনার কথা আশ্চর্যজনক ভাবে নিছক হাসিতে রূপান্তরিত করে গেছেন তিনি।
যদি তার লিরিক গুলোর সাথে পরিচয় না থাকে, তবে তার “ননসেন্স” দিকটি জানা  যাবে না।

যেমন দেখুন একটি উদাহরণ

"There was an old man in a barge,
Whose nose was exceedingly large;
But in fishing by night,
It supported a light,
Which helped that old man in a barge."

( এক বজরায় একটি বৃদ্ধ লোক ছিল,
যার নাক অনেক বড় ছিল;
তবে সে রাতে মাছ ধরতো,
একটি আলোক-শিখা তাকে সহায়তা করেছিল,
যা সেই বৃদ্ধকে বজরায় সাহায্য করেছিল।)

আরও একটি পড়ুন -

"The Goodnatured Grey Gull,
who carried the Old Owl, and his Crimson Carpet-bag,
across the river, because he could not swim.
There was an old man in a tree,
Whose whiskers were lovely to see;
But the birds of the air,
Pluck'd them perfectly bare,
To make themselves nests on that tree."

( সুসজ্জিত ধূসর গাংচিল,
যিনি বুড়ো পেঁচা আর তাঁর গাঢ় লাল রংয়ের কার্পেট ব্যাগ নিয়ে এসেছিলেন,
নদীর ওপারে, কারণ সে সাঁতার কাটতে পারে না।
একটি গাছে একটি বৃদ্ধ লোক ছিল,
যার গালপাট্ট দাড়ি দেখতে সুন্দর ছিল;
তবে বাতাসের পাখি,
সেগুলি পুরোপুরি খালি করতে চাইলো
সেই গাছে নিজেদের বাসা বানাবে বলে।)

                লর্ড ষ্টানলির ছেলেমেয়েরা 'লিয়র'কে খুব ভালবাসতো, লর্ড ষ্টানলি কি ভাবে যেন 'লিয়র'কে জোগাড় করে এনে দিয়ে ছিলেন একটি ছবির সঙ্গে ছড়ার বই। বইটির নাম “Anecdotes and Adventure of fifteen gentlemen”. প্রকাশকাল সম্ভবত ১৮২২। সেই লেখকের নাম আজ গবেষনার বিষয়। এছাড়াও ছিল “The history of sixteen wonderful woman”.

প্রথম ছড়াটি শুনুন তাহলে

"There was a sick man on Tobago
Liv’d long on rich gruel and sago
But at last to his bliss
The Physician said this –
To roast leg of mutton you may go."

( টোবাগোতে একজন অসুস্থ লোক ছিলেন
দীর্ঘকাল নিদারুণ কষ্ট পেয়েছেন
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সুখে-যাত্রা হবে
চিকিৎসক তাকে বলেছিলেন -
ভেড়ার ভাজা রাং আপনি উপভোগ করবেন।)

                  কী দক্ষ হাতে একজন নাম না জানা কবির লিরিকের সাথে ছবি আকলেন 'লিরয়'।
জনজীবনে তা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল লিমেরিক নামে। উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী “light verse” -এর ইতিহাসে এই সব কবিতাগুলি “Nonsense” ছড়া বলে আখ্যা পেয়েছিল।
                     লিয়রের লিমেরিক আর লিরিক, যা তিনি একসময় গান গেয়ে শুনাতেন এক অনাস্বাদিত রূপ আর রসের ভাব বিস্তারে।
                     লিরয়ের ‘A book of Noonsense” অবশ্য প্রকাশিত হয়েছিল ষ্টানলির বাড়ির সেই ঘটনার ১৩ বৎসর পর ১৮৪৬ সালে, এখানে 'লিয়র' এক অদ্ভুত ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। Derry Down Derry.
                      এই বই লেখার পেছনে লিয়রের কোন অমরত্বের চিন্তা ছিল না মাথায় ( নিছক মজা করে লেখা),  কিন্ত অমরত্ব নিজে এসে ধরা দিল লিয়রের কাছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার !

                       'লিয়র' বাবা মার বিংশতম সন্তান। অভাব ছিল তার জন্ম সঙ্গী। বড় বোন অ্যানের কাছে মানূুষ হয়েছেন তিনি। মায়ের বংশধারা থেকে পেয়েছিলেন মৃগী, হাপানি,ব্রঙ্কাইটিসের মত মূল্যবান উপহার।  দৃষ্টিশক্তি ছিল ক্ষীণ। এই সব বেদনা তার স্পর্শকাতর মনটার উপর প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করত। তার থেকে মুক্তি পেতেই যেন তিনি তা লিখে মন থেকে বের করে দিতে চাইতেন।
বিরল এক প্রতিভার অধিকারী হয়েও, স্বচ্ছল জীবনযাপনে তার শত প্রতিবন্ধকতা ছিল। মাত্র পনেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন তিনি দারিদ্রের চাপে। চিত্রকলায় ছিলেন তিনি ভীষণ পারদর্শী। কমপক্ষে বারোটি ভাষায় তিনি কথা বলতে পারতেন। রাগে অভিমানে বিয়ে করেননি। সাধু-সন্তের দেশ শুনে তিনি ভারতে এসেছিলেন বেড়াতে। Bombay Times-য়ে সেসময় তাঁর বিখ্যাত ননসেন্স ছড়াগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৪ সালের জুলাই মাসে, “The Cummerbund” নামে  (মানে “কোমরবন্ধ”)।
শুনুন "কোমরবন্ধ" নামে একটি ননসেন্স ছড়া,
কেমন লাগে দেখুন -

"And where the purple Nullahs threw
Their branches far and wide,--
And silvery Goreewallahs flew
In silence, side by side,--
The little Bheesties' twittering cry
Rose on the fragrant air,
And oft the angry Jampan howled
Deep in his hateful lair.."

( এবং যেখানে বেগুনি নুলা[Nullahs] নিক্ষেপ করেছিলেন
তাদের শাখাগুলি দূর-দূরান্তে -
এবং রৌপ্য গোরিলারা উড়ে গেল
নীরবে, পাশাপাশি, -
ছোট্ট ভেস্টি'র[Bheesties] কিচির মিচির কান্না
সুগন্ধযুক্ত বাতাসে গোলাপ,
এবং ক্ষুব্ধ জাম্পান[Jampan] হু হু করে কেঁদে উঠল
তার ঘৃণ্য কায়দায় গভীরভাবে ..)

                   স্নায়ুরোগের জন্য লিয়র মানুষের ভিড় পছন্দ করতেন না। তাই তিনি কোলকাতার রাজভাবন দেখে বলেছিলেন “Husslefussabud” অর্থাৎ “বড্ড গোলমেলে”।
                      এই জগৎটি চিত্রিত করেছেন 'লিয়র' তার ক্যানভাসে, কিন্ত তা প্রশংসা পেলেও তেমন মর্যাদা পায়নি। শিল্প বিপ্লবের তাড়নায় তখন ইংল্যান্ডে চলছিল সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন। শুধু লিমেরিক বা লিরিকেই না বাস্তবেও নিজেকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন বারবার। সারা জীবন পরেছেন বেঢপ প্যান্ট শার্ট আর নাকের ডগায় ঝুলিয়েছেন মোটা লেন্সের ল্যাগ-ব্যাগে চশমা। তবে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই।
                       একবার একটা সস্তার সরাইখানায় তিনি রাত কাটাচ্ছিলেন, শুনলেন পাশের ঘরে তার ছড়া পড়ে কয়েকজন, তাকে নিয়ে আলোচনা করছে  “How pleasant to know Mr. Lear!

                          একবার ট্রেনে করে 'লিয়র' ভ্রমণ করছিলেন এক অপরিচিত ভদ্রলোক এর পরিবারে সাথে। ভদ্রলোকের বাচ্চারা পড়ছিলেন “A book of nonsense”. ভদ্রলোক লিয়রকে বইটি দেখিয়ে বললেন, এমন মজার বই আর হয় না। কে এক 'এডোয়ার্ড লিয়র'  লিখছেন বইটি, আসলে লেখক লিয়র না ডার্বির আল'। EARL কথাটি ঘুরিয়ে তিনি “LEAR” লিখছেন।
এইসব শুনে বাধ্য হয়ে লিয়রকে বলতে হল তিনিই লিয়র। ভদ্রলোক আর তার পরিবার তো হেসেই বাঁচেন না। বাধ্য হয়ে লিয়রকে জামা খুলে তার গায়ে উল্কিতে লেখা - “EDWARD LEAR”  নামটি দেখাতে হয়। অসহায় 'লিয়র' তখন বাধ্য হয়ে জামা খুলে প্রমাণ করেছিলেন, যে তিনি মিথ্যে কথা বলছেন না। তিনিই আসলে 'লিয়র'। এই ঘটনা পরে অবশ্য তিনি চিত্রিত করে গেছেন তাঁর লিমেরিকে। কী চমকপ্রদ জীবন লিয়রের, ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে বইকি !

------------------------------------------------------
[সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র - অন্তর্জাল]