ল্যাটিন সাহিত্যে নিকানোর পাররার কবিতা (পর্ব - তিন)
শংকর ব্রহ্ম


            দুর্দান্ত সাহসী এই কবির মানুষের ব্যাক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস ছিল প্রখর । ১৯৭৩ সালে চিলির গণমানুষের মহান নেতা সালভাদর আলেন্দেকে এক রক্তক্ষয়ী অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে উৎখাত করে স্বৈরাচারী পিনোশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে চিলির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। চিলির গনতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবিরা তারপর স্বৈরাচারী পিনোশের রোষানলে পড়ে-তাদের ওপর নেমে আসে কঠিন খাঁড়া। কিন্তু, পাররা ছিলেন নির্ভীক-তিনি সান্তিয়াগোর প্রধান গীর্জার প্রবেশমুখে টুপি পেতে বসে যান। কেন?
কারণ তিনি কবিতা পড়ে নির্যাতিত বুদ্ধিজীবীদের জন্য অর্থ সাহায্য করবেন। এমনই মানুষ ছিলেন পাররা।
              নিকানোর পাররা ব্যক্তিজীবনে একজন বিজ্ঞানী। তিনি সুদীর্ঘকাল গণিত আর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। তিনি মার্কিন দেশের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও অক্সফোর্ডে কসমোলজির উপরে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সানতিয়াগোর চিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়িয়েছেন, সেখানে তাকে এমারিটাস প্রফেসর নিযুক্ত করা হয়।
গনিতশাস্ত্র ,পদার্থবিদ্যা, কসমোলজি,তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি পন্ডিতব্যক্তি ছিলেন। মার্কিন বিরোধী মনোভাব লালন পালন করলেও তিনি পদার্থবিদ্যায় পড়াশুনা করেছিলেন মার্কিন দেশে, ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে। প্রতিকবিতা সম্পর্কে বলতে গেলে বই থেকেই একটি লাইন কপি পেস্ট করা যায়,-  "প্রভাব ফেলতে হলে কোনকিছুকে একলক্ষ শ্লোকের মহাভারত হতে হয় না"।
        পাররা কিংবা চেখকবি মিরোস্লাভ হোলুব - এনারা খুব একটা নন্দনতত্ত্বের ধার ধারেন না। কবিতা যেন ঢাল তলোয়ার, রূপের চর্চার চেয়ে শান দেওয়াটাই মূখ্য বিষয়।
            শ্লেষ,ব্যঙ্গ, চাঁছাছোলা ভাষায় শৈল্পিক গালিগালাজও বলতে পারেন। পড়তে অবশ্য বেশ লাগে।
                     কিন্তু আমরা দূর দেশে থেকেও কেন তাঁকে পড়ব?
কবিতা যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন দুনিয়ার ভাষা (আমেরিকা, ওশিয়ানিয়া মহাদেশ) ও পুরনো দুনিয়ার ভাষার মধ্যে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে বারবার, আমরা প্রাচীন দুনিয়ার কাব্যদর্শনে এতটাই অভ্যস্ত যে বেশিরভাগ সময় নতুন দুনিয়ার সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিতে পারি না। মার্কিন সমসাময়িক কবিতার সঙ্গে একেবারেই সংযুক্ত হতে পারি না। অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে কোনও আগ্রহই দেখাই না।
            এখানেই মনে আসে নেরুদার কথা, যিনি ইস্পানো আমেরিকার কাব্যভাষার পিতা। তাঁর হুইটম্যানীয় উচ্চতায় তিনি আমাদের কাছের লোক হয়ে গিয়েছিলেন সহজে। কিন্তু নিকানোর? তাঁর কবিতা তো চিলির, একান্ত, বড়জোর দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের। যে মহাদেশ তার নতুন ভাষা, পুরনো দুনিয়া থেকে আলাদা হবার ভাষা খুঁজে পেয়েছে বিশ শতকে। এবং নিকানোর পাররা সেই ভাষার এক উজ্জ্বল স্থপতি।
       নিকানোর পাররাকে স্পেনীয় ভাষার সর্বোচ্চ সম্মান 'সেরবান্তেস' পুরস্কার দেবার সময় কমিটি জানায় তাঁকে পুরস্কৃত করা হল,  'মৌলিক কবিতা লেখা জন্য।'  এখানেই আমাদের প্রশ্ন জাগে মৌলিক কবিতা কী? বিশ শতকেও মৌলিকতা আসে কোথা থেকে? যেখানে নিকানোর নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর শিকড় সপ্তদশ শতকের স্পেনের কবি ফ্রান্সিস্কো দে কেবেদো?

     আমাদের ঘুরে দেখার প্রয়োজন সেই ইতিহাস, কীভাবে এক মৌলিক কবি, তাঁর পুরনো দুনিয়ার  শিকড় ও ঐতিহ্য সমেত নতুন দুনিয়ার কাব্যভাষা ও দর্শন নির্মাণ করলেন এবং তা উভয় দুনিয়ার কাব্যপাঠকের কাছে পৌঁছে গেল।

কেবেদো তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় লিখছেন:

" কাব্যদেবী শিষ দেয় দেয় না প্রেরণা
সে চেনে আসল প্রতারক
নিজের পকেটে হাত রাখা উদ্দীপক
তাঁর বীণার চাইতে হবে মহৎ এষণা

সে তো অ্যাপোলোর নয়, তারচেয়ে বড় কিছু অনৃত হয় না"।

   এইখানেই ঢুকে পড়েন নিকানোর। তাঁর ঘোষিত রোলার কোস্টার কবিতা নিয়ে, এক ছদ্ম মধ্যবিত্তশ্রেণীর পকেটে হাত দিয়ে চলার, পয়সা গুণে চলার পরিমিত সকাল ও বিকেল আসলে বিরাট ট্রেন যা এক স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে স্থির। নিকানোর লেখেন এক ভালো চোরের ভাষণ।

“আমার কথা মনে করো যখন তুমি তোমার রাজত্বে থাকবে
আমাকে সেনেটের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করো
আমাকে বাজেটের ডিরেক্টার করে দিও
আমাকে প্রজাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রা করে দিও”

নিকানোর লেখেন -
" কুড়ি মিলিয়ন লোক হাওয়া হয়ে যাবার পরেও
স্তালিনকে ঈশ্বর বানানোর বিজ্ঞাপনে
কত খরচা হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়
যে টাকা গোনা যায় ও শব্দ করে
কারণ মনুমেন্ট বানাতে খরচ হয়।

আরও লেখেন -
" পোপ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না।
কী? ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না!
পোপ কোনও কিছুকেই বিশ্বাস করেন না।"

আবারও লেখেন -
" আমি স্পষ্ট বলে দি আমাদের আসলটা কী
বা আমরা তো আগে থেকেই জানি সব
বা আমরা আসলে কিছুই জানি না।

একটাই জিনিস আমাদের জন্য পড়ে থাকে
ঠিক করে কথা বলতে শেখা।"

একই কবিতার ৪ নং অংশে লিখছেন একটিই লাইন:
'আমিই সেই লোক যে সমস্ত রাজরথকে সেলাম করি।'

লেখেন কিছু টেলিগ্রাম:
'টুরিস্ট হিসেবে আমি একেবারেই ফেল মেরে গেছি
বিজয় তোরণ নিয়ে ভাবতে বসে
আমার গায়ে কাঁটা দেয়।

আমি আসছি মিশরের পিরামিড থেকে।
সত্যি বলছি সত্যি করে বলছি
সমস্ত ক্যাথেড্রাল আমার বিচিতে সুড়সুড়ি দেয়।'

    এই সমস্ত উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয় নিকানোর পাররা এমন এমন এক অঙ্গীকারের নাম যিনি আমাদের সামনে আমাদের নগ্ন করে দেখান। আমাদের গোপনতম চাহিদাগুলো আমাদের সামনে মেলে ধরেন আমাদেরই রাস্তার ভাষায়, আমাদের খিস্তি-খেউড়ে।
      নিকানোর পাররার একমাত্র সম্পাদক নিয়াল বিনস বলেছিলেন নিকানোর পাররার বিশ্বজনিনতা নিয়ে।  তিনি বলেছিলেন নিকানোর-এর মূল প্রবণতা অন্তরতম ঈশ্বরহীনতাকে ফুটিয়ে তোলা। এ'ছাড়াও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ও সমাপতন নিকানোর এর “অবান্তরতা”- কে স্বীকৃতি দেয়। তা হল চিলেতে পিনোচেতের শাসন। যখন প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবি দেশ ছেড়েছেন, নিকানোর থেকে গিয়েছিলেন। অদ্ভুতভাবে তাঁকে সাধারণ ঝামেলা ছাড়া তেমন কিছু কষ্ট পেতে হয়নি। যেমনটা বা ঘটেছিল সহস্র সাধারণ চিলেনোর জীবনে, যেমনটা বা ঘটে থাকে আমাদের দেশেও বা প্রতিটা দেশে। আমরা চুপ করে দেখে যাই, শুনে যাই যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজেদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে হিংসা। নিকানোরের ক্ষেত্রে কিন্তু হিংসা তাঁর বাড়িতে ঢুকেছিল। তাঁর বোন বিওলেতা পাররা আত্মহত্যা করেন রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপে। যেমনটা ঘটেছিল প্রায় প্রতিটি ঘরে, চিলিতে। প্রায় প্রতিটা পরিবার থেকে কেউ  না কেউ “হারিয়ে গিয়েছেন”, যাঁদের দেহাবশেষ খুঁজতে দেখা যায় শত শত মানুষকে, আতাকামা মরুভূমিতে। নিকানোর কীভাবে থেকে গিয়েছিলেন সেই দেশে। কেনই বা তাঁকে মেরে ফেলেনি রাষ্ট্রযন্ত্র? যেমনটা বা দেখা যায় কুবাতে, ফিদেল কাস্ত্রো সবাইকে দেশ থেকে তাড়ালেও বুর্জোয়া কুবার প্রতীক দুলসে মারিয়া লোইনাস-কে ছাড় দেন।
           এর উত্তর আমরা পাই ২০১২ সালে। যখন নিকানোর-এর উপর দীর্ঘ এগারো বছর ধরে নির্মিত তথ্যচিত্র “প্রতিকবির প্রতিকৃতি” (পরিচালনা: বিক্তোর খিমেনেস আতকিন) দেখি। যেখানে নিকানোর বলছেন “এক অর্থে তিনি এক ত্রাতা, কারণ পিনোচেত না এলে আমদের অবস্থা কুবার মতো হত। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা ভুলে যেতে পারি না তাঁর হত্যাকাণ্ডের কথা”।
         কেন চিলেতে সালবাদোর আইয়েন্দে সফল হননি, কেন পিনোচেত ক্ষমতায় এসেছিলেন তার পিছনে আছে এক বুর্জোয়াতন্ত্রের ইতিহাস। চিলের মানুষ ভয় পেয়েছিলেন যে তাঁদের দেশ কুবা হতে চলেছে। নিকানোর পাররা এই বুর্জোয়তন্ত্রেরই কবি, যিনি ভিয়েতনামের সময়ে নিকসনের স্ত্রীর সঙ্গে চা খেয়েছিলেন। নিয়াল বিনস এইসব ঘটনাক্রমকে বলেন সত্যের কাছে যাওয়ার চাবিকাঠি। হ্যাঁ। আমরা প্রতিনিয়ত যে অবান্তরতার মধ্যে ঢুকে পড়ি, ক্ষমতার সামনে এলে আমাদের বুক শুকিয়ে যায়, আমরা দল বদলে ফেলি চকিতে, এবং পরমুহূর্তেই নিজেদের ঘনিষ্ঠ মহলে ছড়া কাটি, নিকানোর পাররা সেই আমাদের প্রতিনিধি। তফাৎ শুধু একটাই তিনি কবিতায় ধরেছেন সেই দ্বন্দ্ব। শুধু বন্ধুদের মধ্যে নয়, সর্বজনে ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই অবান্তর দুনিয়ার ভাষ্য। আর এখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের কবি। আমাদের সকলের কবি।