ল্যাটিন সাহিত্যে নিকানোর পাররার কবিতা (পর্ব - চার)
শংকর ব্রহ্ম


                      পাররা পরবর্তী চিলের গুরুত্বপূর্ণতম কবি
রাউল সুরিতার মতে উঠে এসেছিল ভাষার উপরে নিকানোর পাররার অত্যাচারের কথা, বিপ্লবের কথা। নিকানোর তুলে এনেছিলেন প্রাত্যহিক মানুষের মুখের কথা। তাঁর কবিতা ছিল সেই বিপ্লবের মুখ যা চিলির মানুষ প্রতিদিন তাঁদের বেঁচে থাকা দিয়ে পিনোচেত-এর অত্যাচারের সময়ের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন।
                     আর এখানেই আসে ভাষার প্রসঙ্গ। যেভাবে ফ্রান্সিসকো দে কেবেদো স্পেনীয় ভাষার কবিতার লিরিকটানকে অগ্রাহ্য করে ভাষার শরীরে চালান করে দিয়েছিলেন মাদ্রিদের রাস্তার কথা সেভাবেই নিকানোর পাররা আমাদের সুপ্ত অভিপ্রায়কে তুলে ধরে ফেলেছেন আমাদেরই ভাষায়, যে ভাষা কোনও কবিই লিখতে সাহস পাবেন না। আর এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক। আমাদের দ্বন্দ্ব, আমাদের ভয় ও আচরণ তিনি লিখে গেছেন এক দক্ষ বিজ্ঞানীর মতো। কোনও কথা বলতেই ভয় পাননি। ব্যবহার করেছেন প্রাচীন ও নতুন শব্দ। ঢুকে গেছেন আমাদের শিরায়, যে শিরা বহন করেন ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিটা মানুষ। তিনি হয়ে উঠেছেন সেই সময়ের আয়না যখন গোটা চিলি ভেবেছিল পিনোচেত দেশটাকে শুধরে দেবেন। হয়ে উঠেছেন সেই সময়ের বিবেক যখন মানুষ তার ভুল বুঝে সংগ্রাম করেছে। এবং এই সবকিছু তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এক কবিতার ভাষায় যা অশ্রুতপূর্ব আর তাই তাঁর কোনও উত্তরসূরি নেই। শুধু আছে ভাষায় তার ছাপ যা সমসাময়িক চিলির কবিকে আর তাঁকে কাব্যিক ভাষা ও বিষয় খুঁজতে দেয় না। সে সবসময় কিছু নিয়েই কবিতা লিখতে পারে।

" আমি প্রস্তাব করছি সভা মুলতবি থাক সেনিওর এবং সেনিওরাগণ আমার শুধু একটাই প্রশ্ন: আমরা কি সুর্যের সন্তান না কি মাটি পৃথিবীর? কেননা যদি আমরা শুধু মাটিই হই আমি কোন কারণ দেখি না এই ছবিটার শুটিং চালিয়ে যাবার! আমি প্রস্তাব করছি সভা মুলতবি থাক।
       কোন কারণে ফ্রয়েড সাহেবের উপর বেজায় ক্ষাপ্পা ছিলেন তিনি।
তিনি জানান, জিগমুন্ট ফ্রয়েড মুখভর্তি পালক নিয়ে পাখি মনোচিকিৎসকদের আর সহ্য করবে কে? তারা সবকিছুই জড়িয়ে নেয় যৌনতার সঙ্গে।
     সবচেয়ে তাজ্জব সব দাবী পাওয়া যায় ফ্রয়েডের রচনায়।
         এই সেনিওরের মতে সমস্ত উত্তল(convex) জিনিশই - ঝরণা-কলম, পিস্তল, মুগুর, পেনসিল, গড়গড়া, ডাম্বেল- পুংলিঙ্গের প্রতীক; আর সমস্ত অবতল( concave) স্ত্রী-যোনির প্রতীক।
        কিন্তু মনোচিকিৎসা এগিয়ে যায় আরও অনেকদূর শুধু যে উত্তল আর অবতল তাই নয় প্রায় সব জ্যামিতিক বস্তই প্রতীক হয়ে ওঠে যৌন কারখানা যেমন মিশরের পিরামিড যার নজির  কিন্তু তাই সব নয় আমাদের নায়ক কিন্তু আরো এগোন: যখন আমরা কোন হাতের কাজ দেখি যখন দেখি ধরা যাক বাতি কিংবা টেবিল যা মনোচিকিৎসক দ্যাখেন পুরুষাঙ্গ আর যোনি  ............................................................ ............................................................. আমরা দেখতে পাই এক মোটরগাড়ি মোটরগাড়ি পুরুষাঙ্গের প্রতীক আমরা দেখতে পাই একটা বাড়ি উঠছে বাড়ি আসলে পুরুষাঙ্গের প্রতীক আমাদের নেমতন্ন করেছে সাইকেল করে বেড়াতে যেতে বাইসাইকেল পুরুষাঙ্গের প্রতীক ............................................................. ............................................................. আমরা খাই রুটি মাখন মাখন পুরুষাঙ্গের প্রতীক এক বাগানে আমরা খানিক জিরিয়ে নিই প্রজাপতি পুরুষাঙ্গের প্রতীক টেলিস্কোপ পুরুষাঙ্গের প্রতীক বাচ্চা যে বোতল থেকে দুধ খায় তা ও পুরুষাঙ্গের প্রতীক ............................................................. ............................................................. কাজেই দেখছেন তো আমি চটে যাই নি মোটেই আপনাকে আমি চাঁদটাই দিয়ে দিচ্ছি সত্যি সত্যি ভাববেন না আপনাকে নিয়ে আমি কোন ইয়ার্কি করছি: অগভীর ভালোবাসার সঙ্গে সেটা আপনাকে উপহার দিচ্ছি আমি আমি কোন ঠ্যাং ধরে টানবার চেষ্টা করছি না মোটেই যান নিজেই গিয়ে সেটাকে আপনি তুলে আনতে পারেন আপনার খুড়ো যিনি আপনাকে ভালোবাসেন আপনার রঙ বেরঙের প্রজাপতি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে আসছেন পবিত্র বেদী থেকে

কতবার একথা বলবো আপনারা নিয়ে আসুন কিছু কীটনাশক ছাদ থেকে সাফ করে দিন মাকড়শার জাল জানলাগুলো ধুয়ে দিন মাছির গুয়ে ভরা সব কাচ ধুলো ঝাড়ুন আসবাবগুলো থেকে আর সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরী এই পায়রা গুলোকে তাড়িয়ে দিন তো ওগুলো সবসময়েই আমার গাড়ির উপর হাগছে কোথায় রাখলেন বলুনতো দেশলাইগুলো( কবিতাটিতে কোন বিরতি চিহ্ন নেই)।
আটটি ছোট সাইজের একসাথে করে নাম দেয়া হয়েছে তারবার্তাগুলি। তারবার্তাগুলি ১. ঢের হয়েছে ক্যাবলামি এখানে ফরাশগুলোর তলায় কিছুই ঝাঁট দেয়া হয় নি। ঈশ্বর জগৎটা সৃষ্টি করেছেন সপ্তাহজুড়ে আমি সেটা একমুহূর্তে ধ্বংস করে দিই।

২. ............................................................. ............................................................. আমি বামপন্হীও নই দক্ষিণপন্হীও নই আমি শুধু সব ছাঁচ ভেঙে ফেলি।
. ............................................................. ............................................................. আমি এসেছি মিশরের পিরামিডগুলো থেকে সত্যি সত্যি ক্যাথিড্রালগুলো আসলে আমার বিচি ধরে টান দেয়। আরও সতেরোটি একসাথে করে : চেয়ারে বসে ঘুম লাগায় এমন এক কবির কাছ থেকে পনেরো নম্বর চিঠিটা শুনে দেখুন।

আপাদমস্তক এ্যান্টিপোয়েটিক হয়ে যাবেন!
১৫ নম্বর চিঠি) .
" শেষবারের মতো আমি বলে যাচ্ছি কথাটা শূককীটেরা হলো দেবতা প্রজাপতিরা সব অনিবার ছোটা ফুল খাওয়া, খঁওয়া দাঁত সহজেই ভেঙে যায় আমি হচ্ছি নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগের লোক। যৌনতা এক সাহিত্যকর্ম। হুঁশিয়ারি কোনো প্রার্থনা চলবে না , হাঁচিও না। থুতু ফেলা নয়,বাহবা দেয়া নয়, হাঁটু গেড়ে বসা নয় পূজো না, চীৎকার না, ডুকরানি না, কেশে কেশে কফ তোলা না। এ তল্লাটে ঘুমোবার অনুমতি নেই।
     কোনো টিকে দেয়া না , কথাবার্তা না, দল থেকে তাড়িয়ে দেয়া না। চোঁ চোঁ দৌড় না,পাকড়ে ফেলা না। ছোটা একেবারেই নিষেধ। ধূমপান নিষেধ । সঙ্গম বারণ।"

"আধুনিক মানুষ একটা ফাঁদে পড়ে গিয়েছি মাত্র সাতটা রাস্তাই খোলা আছে তার কাছে আর তাদের কোনো টাই রোম অব্দি নিয়ে যায় না। এইসব পড়তে পড়তে প্রায় একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খায়-- কাকে বলে কবিতা যদি তা না-বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষ?" - চেশোয়াভ মিউশ।

        আইয়েন্দের হত্যার পর তাঁকে বেশ কিছুদিন নির্বাসনে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল।  ২৩ই জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন সারাজীবন হাঁপানিতে ভোগা–শুধু চিলিতে নয় লাতিন আমেরিকাতেও নয় গোটা দুনিয়ার সাহিত্য জগতে নতুন ঢেউ নিয়ে আসা–এই অমর কবি। ভবিষ্যত কবিতার মুভমেন্টগুলোরও বাঁকে বাঁকে দেখা যাবে তাকে।
    নোবেল প্রাপ্তির তালিকায় চারবার শর্ট লিস্টেট হযেছিলেন তিনি। কিন্তু, কী এক অজ্ঞাত কারণে শেষপর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পাননি তিনি। ২০১১ সালে স্প্যানিশ ভাষার সেরা সাহিত্য সম্মান 'Premio Cervantes' পান। ১৯৮৯ সালে ‘বিশ্ব কবিতা উৎসবে’ যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন নিকানোর পাররা।
নেরুদার প্রয়াণের পরে তাঁর তুল্য জনপ্রিয় কবি আর কেউ ছিলেন না সে দেশে।