ল্যাটিন সাহিত্যে নিকানোর পাররার কবিতা (পর্ব - এক)
শংকর ব্রহ্ম
'নিকানোর পাররা' কবি হিসাবে আমাদের অনেকের কাছেই তেমন পরিচিত নাম নয়। অনেকেই তার কবিতা পড়েননি। যারা পড়েননি তাদের কথা ভেবেই, এই আলোচনার অবতারণা তাঁর প্রসঙ্গে।
পাবলো নেরুদার পর চিলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আশ্চর্য শক্তিশালী কবি নিকানোর পাররা। প্রচলিত লোকগীতির ধারাকেই কথ্য ভাষার সাথে মিশিয়ে শ্লেষাত্মক দুর্লভ কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর “কবিতা ও বিরুদ্ধ কবিতা” একটি উল্লেখ্য কাব্যসংকলন।
নিকানোর পাররা লাতিন আমেরিকার চিলির কবি।
১৯১৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর নিকানোর পাররার জন্ম দক্ষিণ চিলির সান ফাবিয়ন শহরে, এক দরিদ্র পরিবারে ।
তাঁর বাবা ছিলে একজন স্কুল শিক্ষক। তাঁর বোন ভিওলেতা পাররা ও ভাইপো আনহেল পাররা লাতিন আমেরিকার সেরা সঙ্গীতকারদের মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হন। মার্কিন মদদে সালভাদর আইয়েন্দেকে হত্যা করে সামরিক শাসক হেনেরাল পিনোশেৎ চিলেতে সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করার পর আনহেল পাররা ফ্রান্সে পালিয়ে যান, তখন ভিক্তর হারাকে সানতিয়াগোর ফুটবল মাঠে খুন করা হয়। প্রথমে তার গিটার বাজানোর হাত কেটে ফেলে, পরে গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলে। ভিয়োলেতা পাররা আত্মহত্যা করেছিলেন। তখন কবি শিল্পী চলচ্চিত্রকাররাই সকলেই ছিলেন পিনোশেতের প্রত্যক্ষ সমালোচক। 'চিলিতে গোপনে' বলে একটা বই লিখেছিলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। সেখানে চিলির নির্বাসিত বিপ্লবী চলচ্চিত্র পরিচালক মিগুয়েল লিত্তিনসহ চিলির বিপ্লবী সংস্কৃতিকর্মীদের দুঃসাহসী অভিযানগুলো বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কারণে অঙ্কশাস্ত্রবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিতি পেলেও তিনি চিলির এবং লাতিন আমেরিকার একজন প্রধান কবি হিসাবেই স্বীকৃত। লাতিন আমেরিকায় ‘অ্যান্টিপোয়েম’ এবং ‘এমারজেন্সি পোয়েম’-এর ধারণাকে ও চর্চাকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এ'ছাড়া সনাতন বুর্জোয়া নন্দন-তত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তাঁর কবিতাকে তিনি তীব্র গদ্যধর্মী করে তোলায় প্রয়াসী হয়েছিলেন।
সারাজীবন হাঁপানিতে ভোগার পর, ২০১৮ সালের ২৩ই জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন এই অমর কবি ১০৪ বছর বয়সে। শুধু চিলেতে নয় লাতিন আমেরিকাতেও নয়, গোটা দুনিয়ার সাহিত্য জগতে নতুন ঢেউ নিয়ে আসেন তিনি।
নিকানোর পাররা স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী কবি। কবিতার প্রথাগত শৈলী ও বিন্যাস ভেঙে রচনা করেন anti-poesia বা প্রতি-কবিতা। নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হন। ২০১১ সালে হিস্পানিক সাহিত্যের সর্বোচ্চ মর্যাদা ‘সের্ভান্তেস পুরস্কার’ লাভ করেন।
নিকানোর পাররার কবিতা পড়ে প্রতিক্রিয়া না দেখানো প্রায় অসম্ভব। এখানেই হয়ত তাঁর কবিতার শক্তিমত্তা। কবিতা পড়তে পড়তে হয়ত মনে হতে পারে এ আদৌ কবিতাই নয়। এতদিন ধরে গড়ে ওঠা কবিতার ধারণাকে ভেঙে ফেলার জন্যই বুঝি এই কবিতা। নিকানোর পাররার কবিতাগুলো যদি কবিতা হয়– প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয় যে তাহলে আগে আমরা কবিতা নামে যা পড়েছি তা কী? তিনি তাঁর এই কবিতাসমূহের নাম দিয়েছিলেন 'Anti-Poetry' ('প্রতি-কবিতা')। নিকানোর পাররার কবিতার বই প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সত্যিকার অর্থে বিশ্বকবিতায় সূচিত হয়েছিল নতুন এক কবিতার যাত্রা। প্রতি-কবিতা। বলা হয়ে থাকে যে কবিতা এখন কোথায় সেটা জানতে গেলে প্রতি-কবিতা পড়তে হবে। এটি কবিতার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। তিনি নিজেই তার একটা কবিতায় বলেন -
" পৃথিবীতে কোনোকিছুই আপনাআপনি আলপটকা ঘটনা
দাদইজম
কিউবিজম
সুররিয়ালিজম
অথবা আত্মার আত্মপরাজয়
যা হয়/তা আগে যা ঘটেছে তারই যুক্তিসিদ্ধ ফলাফল।
[হলোকস্ট; শ্রেষ্ট কবিতা ও প্রতিকবিতা, অনুবাদ: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়]