ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


            নেরুদা একা হয়েও তার লেখনীর কারণে বহুধাগুণে গুণান্বিত। তিনি যেমন ছিলেন একজন স্পষ্টভাষী, চিৎকৃত, দায়বদ্ধ আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগত, নিভৃতমনা, পরাবাস্তববাদী। প্রেম তার কবিতার অনিবার্য এক দিক; প্রেম দিয়ে যেমন আচ্ছন্ন মনের বেদনা লুকাতে চেয়েছেন তেমনি প্রেম দিয়ে গ্লানিকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। কবি মনের বিষাদ ভুলতে কবি লেখেন- রেসিডেন্স অন আর্থ, বইটি এ বইয়ের- আর্স পোয়েটিকা, ওড টু ফেদেরিকা গার্সিয়া লোরকা, স্পেন ইন আওয়ার হার্ট, এরকম অনেক কবিতা আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার- ক্যান্টো জেনারেল- এক বিচিত্র মহাকাব্য পনেরো খ-ের বইটিতে ২৩১টি কবিতা রয়েছে।

              ১৯৭৩ সালে নেরুদা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি তার কবিতার জন্যে পৃথিবী জোড়া খ্যাতি লাভ করেন যেমনি তেমনি সামরিক শাসকের শ্যেনদৃষ্টিতেও পড়েন। চিলির সামরিক শাসক পিনোচেট,  অনেকে শঙ্কা করে নেরুদার অসুস্থতার সময় ডাক্তারকে নির্দেশ দেয় তাকে প্রাণঘাতী বিষ প্রয়োগ করার জন্যে। মৃত্যুর পড়ে তিনি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বলে রটনা করা হয়। চিলির সামরিক শাসক অগাস্তো পিনোচেট নেরুদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জনসমক্ষে অনুষ্ঠিত করার অনুমতি দেননি। যদিও হাজার হাজার মানুষ সেদিন কার্ফ্যু ভেঙ্গে পথে ভিড় জমান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিণত হয় চিলির সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণপ্রতিবাদে।

              অক্টাভিও পাজও কবি হবার পাশাপাশি কূটনৈতিক ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে ম্যাক্সিকো সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখায় ম্যাক্সিকান ও ইউরোপিয়ান দুই ধারাই পরিলক্ষিত। খুব ছোটকাল থেকেই তার দাদার সূত্রে প্রাপ্ত লাইব্রেরীতে তার পড়া ও সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ- বন্য চাঁদ- ১৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তবে তার অনেক আগে থেকেই তিনি কবি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। তিনি শহর ছেড়ে, ইয়োকাতান রাজ্যের একটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন কবিতা চর্চার জন্য। এখান থেকে প্রকাশিত হয় তার কাব্য গ্রন্থ- পাথর এবং ফুলের মধ্যে। এটি টি.এস. এরিয়ট দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং ম্যাক্সিকোর চাষিরা কিভাবে জমিদার দ্বারা শোষিত তার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে কাব্য প্রতিভা প্রকাশিত হতে থাকলে তার দেশে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন তিনি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক লেখক কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হন এবং এখানে তিনি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে ওয়ার্কশপ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত করেন। তিনি এলেনা গারোর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; অনেকের মতে এলেনা ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে চমৎকার লেখিকা। কিন্তু তাদের বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরপরে অক্টাভিও পাজ আমেরিকায় পাড়ি জমান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের জন্য। এর ফলশ্রুতিতে তার গ্রন্থ- দ্য লিবারিন্থ অব সোলিচুড প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক টাইমস এটাকে ম্যাক্সিকোর পর্যালোচনা হিসেবে গণ্য করে এবং এটাতে ম্যাক্সিকোর ব্যক্তিত্ববোধকে অক্টাভিও পাজ নেতিবাচক বলে ধারণা করেন। এরপরে তিনি ভারত, জেনেভা, টকিওতে কূটনৈতিকের দায়িত্ব পালন করে দেশে ফিরে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সানস্টোন- রচনা করেন। তার উত্তরোত্তর খ্যাতি বাড়তে থাকে এরপরে ১৯৫৯ আবার প্যারিসে কূটনৈতিকের দায়িত্বে পাঠানো হয় এবং ১৯৬২ সালে ভারতের এ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপরে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দান করেন। সেখানে তিনি চার্লস এলিয়ট নরটন প্রফেসরশিপ হিসেবে গণ্য হন। পরবর্তীতে তার বক্তৃতাটি চিলড্রেন অব মায়ার নামে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। সেমুয়েল বেকেটের মতো লেখকরা তার লেখা অনূদিত করেন। তার লেখায় ম্যাক্সিকান পরাবাস্তবতা, অস্তিত্বের সংকট, বুদ্ধের দর্শন এবং হিন্দু ধর্মের দর্শন এই সকল বিষয় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। তার কাব্যগ্রন্থের পরাবাস্তবতাকে; বিশেষ করে সানস্টোন এ- নোবেল কমিটি অক্টাভিও পাজের অনবদ্য সৃষ্টি বলে ঘোষণা করে। তার পরবর্তী কালের অনেক কবিতা প্রেম ও যৌনতা নিয়ে লেখা। তাছাড়া গভীর আবেগ, আধুনিক চিত্রকলা, নৃতত্ত্ব, আজটেক শিল্প যেগুলো অন্য বড় কবিদের মধ্যে পাওয়া যায় তার কবিতার উপজিব্য বিষয়। ম্যাক্সিকোর ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তার লেখা ম্যাক্সিকান কালচার অন্যান্য ম্যাক্সিকান লেখকদের প্রভাবিত করেছে। ইলান স্টেভানের মতে অক্টাভিও পাজ হচ্ছেন দান্তের আধুনিক রূপ। এছাড়াও অক্টাভিও পাজ প্রবন্ধ ও নাটকও রচনা করেন। অক্টাভিও পাজ ছোট গল্পের ক্ষেত্রে নাথানিয়েল হথর্ন ও ইয়েটস দ্বারা প্রভাবিত হন। ইংরেজী ছাড়াও তার লেখনীতে স্পানিস, জাপানিজ, ভারতীয় প্রভাব তার সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের মর্যাদা দান করে।