ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (প্রথম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম    


                   নোবেল পুরস্কারকে ধরা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্মাননা হিসেবে। কিন্তু ১৯০১ সাল থেকে প্রচলিত এই পুরস্কার নিয়ে আজ অবধি অনেক বিতর্কও চলে আসছে নানা কারণে,  এই যেমন সাহিত্যে নোবেল প্রথমবার সবাই ধরে নিয়েছিল নির্দ্বিধায় পাবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিক রাশিয়ার লিও টলস্টয়। কারণ সেই সময় লিও টলস্টয় ছাড়া আর কাউকে সাহিত্যে নোবেলের দাবীদার ভাবাটা কষ্টকর ছিল। কিন্তু সুইডিস একাডেমি সবার আকাঙ্খাকে পাশ কাটিয়ে নোবেল দিল ফ্রান্সের সুলি প্রুধম বা রেনে ফ্রানকোকে। আমরা জানি সুইডেন ও রাশিয়ার পুরনো দ্বন্দ্বের কারণে রাশিয়ানরা সবসময় নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, আর সেই কারণে হেনরিক ইবসেন, টলস্টয়, আন্তন চেখব, ছাড়া -  ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস ও রবার্ট ফ্রস্টের মতো পৃথিবী শ্রেষ্ঠ লেখকদের নোবেল না দেয়া কোন অংশেই তাদের লেখনিকে খাটো করেনি বরং নোবেল কমিটিই এতে তাদের  দীনতা প্রকাশ করেছে। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এ পর্যন্ত যত নোবেল দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই গেছে ইউরোপীয়ানদের হাতে। এ'ক্ষেত্রে, এশিয়া বা লাতিন আমেরিকানরা ছিলেন অনেক উপেক্ষিত। এটার পিছনে অর্থনৈতিক প্রভাব ও রাজনৈতিক শক্তিকে কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

           তবে এশিয়ার প্রথম নোবেল একজন বাঙালী আর বাংলা ভাষীর কাছে আসাটা নিঃসন্দেহে একটা অসামান্য কৃতিত্ব। রবীন্দ্রনাথের প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল লাভ যেমন এশিয়াকে গৌরবান্বিত করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে এটি সুউচ্চ স্তরে নিয়ে গেছে। তবে অনেক নিন্দুক রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাবার পিছনে অনেক ধরণের তীর্যক মন্তব্য করেন। তবে রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যের কাজ দিয়ে একটা ভাষাকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন,  তার ছোট গল্প, নাটক, কাব্য, উপন্যাস, গান, সুর, গীতনাট্য ও দার্শনিকতা সেই সঙ্গে অসামান্য সাহিত্য প্রতিভা নোবেল কমিটিকে বাধ্য করেছিল রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল দিতে। তার গীতাঞ্জলি যার জন্য তিনি নোবেল পান তার ভূমিকাতে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা কবি ডাবলিউ. বি. ইয়েটস লিখেছিলেন 'আজ থেকে শত বছর পরেও গীতাঞ্জলির গানগুলো (এটি কবিতা ও গানের সমন্বয়) হাটে, মাঠে, নদীর ঘাটে গাওয়া হবে' -  যা মিথ্যে হয়নি। দিনে দিনে রবীন্দ্র সাহিত্য আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও যুগোপযোগী হয়ে উঠছে। তবে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিটা উপভোগ করেছিলেন? তা একটি গানে উনি প্রকাশ করেছেন, -
'এই মণিহার আমার নাহি সাজে/
এরে পরতে গেলে লাগে,
এরে ছিড়তে গেলে বাজে’
শুনলেই বোঝা যাবে। কবির আকুতি ছিল-

'ফুলমালার ডোরে/ বরিয়া লও মোরে’।

            ইউরোপ ছাড়া এশিয়া ও লাতিন আমেরিকানদের নোবেল পাওয়াটা একটা বিশেষ কৃতিত্বের কারণ তা তারা অর্জন করেছেন তাদের অসামান্য সৃষ্টিশীল প্রতিভার জন্যে, সাহিত্য জগতে নতুন নতুন অধ্যায় সৃষ্টির জন্যে, আমরা এখানে এমনি কয়েকজন লাতিন আমেরিকান নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে আলোচনা করব যাদের জন্যে বিশ্ব সাহিত্য আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে এবং পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এদের মধ্যে যারা নোবেল পেয়ে নোবেলকে আরও ঔজ্জ্বল্য দান করেছেন তারা হলেন- চিলির গ্যাব্রিয়াল মিস্ত্রাল (১৯৪৫), গুয়াতেমালার, মিগুয়েল এনজেল অস্ত্রিয়াস (১৯৬৭), চিলির পাবলো নেরুদা (১৯৭১), কলাম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯৮২), ম্যাক্সিকোর অক্টাভিও পাজ (১৯৯০) ও পেরুর মারিও বার্গাস ইয়োসা।

                গ্যাব্রিয়াল মিস্ত্রাল মূলত প্রথম স্পানিস আমেরিকান কবি যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার আসল নাম 'লুসিয়া গথোয় এলাকায়গা' কিন্তু হিস্পানিক বিশ্বে সবাই আদর করে তাকে গ্যাব্রিয়াল বলে ডাকে। চিলির এই নারী কবিকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করতে গিয়ে নোবেল কমিটি বলেন, তার নামটিই সমগ্র লাতিন আমেরিকার আদর্শগত প্রতীক হয়ে উঠেছে।’  তিনি লাতিন আমেরিকার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি। তাই তিনি এই মহাদেশের সাহিত্য অঙ্গনের প্রধান প্রতিনিধি হয়ে থাকবেন চিরকাল। তিনি এই অঞ্চলের সাহিত্যিক মূল্যবোধ, চিন্তাধারা, ঐতিহ্যকে সারা পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেন। শুধু কবি হিসেবেই নয় চিলির ইতিহাসে তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কূটনৈতিক, নীতি নির্ধারক, নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় একাগ্র কর্মী হিসেবে অমর হয়ে আছেন। তাছাড়াও এই বিশিষ্ট কবি তার রচনায়, প্রবন্ধে, বক্তৃতায়, পত্রিকা লেখনীতে শিশু, অসহায় নারী, যুদ্ধাহত, শ্রমিক, গরিবদের রক্ষার জন্য তার সহমর্মিতা দেখান। শুধু তাই নয় তাদের জন্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। তিনি চিলির এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৮৯ সালের ৭ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার সাফল্যের পিছনে বাধা বিপত্তি ছিল নিত্য সঙ্গী। গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তার শুরু,  পিতৃহীন দরিদ্র পরিবারকে রক্ষার তাগিদ নিয়ে। আর এই শিক্ষকতাই তার সাহিত্য চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। বাবাকে ছোট বেলায় হারানো, বিকলাঙ্গ মা আর সতেরো বছর বয়সে প্রেমিক পুরুষের আত্মহত্যা তাকে বিমর্ষ করে দেয়। তিনি এই বেদনা ভুলতে আরও বেশি কবিতার জগতে ডুব দেন। তার কবিতার মূল উপজিব্য মৃত্যু ভাবনা, ভালবাসা, মায়া ও লাতিন আমেরিকান জীবন। যেহেতু দারিদ্র্যের মাঝেই তার ছিল বসবাস ও চিলির দরিদ্র মানুষজনদের কাছ থেকে দেখেছেন তার কবিতায় এর ছাপ পড়ে আর ধীরে ধীরে তার কবিতা দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে, 'মৃত্যুর জন্য সনেট’ (১৯১৪)- এর জন্য তিনি চিলির জাতীয় পুরস্কার হোর্হেস ফ্লোরালেস এ ভূষিত হন। ১৯২২ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত তার ডেজোলেশান একটি সাহিত্যিক মাইলফলক,  এটিই তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয় এটি কবিতা ও প্রবন্ধের সংকলন ছিল। তার গীতি কবিতার ধারা পরবর্তীতে সমগ্র লাতিন আমেরিকার আদর্শগত ধারা হয়ে ওঠে। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মগুলো হলো : -  
মৃত্যুর জন্য সনেট গুচ্ছ, নিরুদ্দেশ, নারীর জন্য পাঠ, নিষ্পাপ শিশুর জন্য গান, সাদা মেঘ ও চিলির গান, ফসল ফলানো ইত্যাদি।