ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


               মিগুয়েল এনজেল অস্ত্রিয়াস হলেন গুয়াতেমালার নোবেল বিজয়ী কবি, কূটনৈতিক, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। তার অবদান লাতিন আমেরিকার মূল ধারার সাহিত্যকে পশ্চিমা ধারার সাহিত্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করানোতে এবং একই সঙ্গে স্বজাতীয় সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করানো,  বিশেষ করে গুয়াতেমালার সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। তার জীবনের একটা বড় সময় দেশের বাইরে কাটে। তার প্রথম জীবনের পড়া লেখা হয় প্যারিসে মানবজাতি বিষয়ে। তিনি প্রথম সাহিত্যিক যিনি দেখান কিভাবে নৃতত্ত্ব ও ভাষার বৈজ্ঞানিক ব্যবহার সাহিত্য লেখনীতে প্রভাব ফেলে। প্যারিসে থাকাকালীন অস্ত্রিয়াস সুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তব আন্দোলনেও জড়িত ছিলেন এবং মর্ডানিস্ট সাহিত্যের অনেক বিষয় তিনি লাতিন সাহিত্যে প্রয়োগ করেন। এভাবে তিনি ১৯৬০-৭০ এর দশকে- লাতিন আমেরিকান বুম- যা এই অঞ্চলের সাহিত্য ধারণাকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করে খ্যাতি লাভ করেন অস্ত্রিয়াস এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেলও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার উপন্যাস মিস্টার প্রেসিডেন্ট (১৯৪৬) লাতিন সাহিত্যের এক বড় মাইলফলক এটি লাতিন অঞ্চলের শাসকদের স্বৈরাচারিতার রূপ অন্বেষণ করে ও সমাজে এর প্রভাব অনুসন্ধান করে। রাজনৈতিক অপশাসনের বিরুদ্ধে তার লেখনী সবসময় উচ্চকিত ছিল। তিনি যে জন্য বিশিষ্ট হয়ে থাকবেন তা হলো সাহিত্যে তার নতুন নতুন কলাকৌশলের প্রয়োগ। তিনি প্রথম সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের প্রয়োগ করেন পরবর্তীতে মার্কেল এটির পূর্ণতা দেন। সামাজিক অন্যায়ের নানা দিক তার সাহিত্যে রূপায়িত হয়েছে কারণ লাতিন আমেরিকায় এটি বিশেষভাবে প্রথিত। স্বৈরশাসকের অধীনে জীবন যাপনের যন্ত্রণাময় ও বিভীষিকাময় রূপ মিস্টার প্রেসিডেন্টে প্রতীয়মান। তার স্বপ্ন চিত্রময়তা, অনুকারশব্দ, প্রতীক, শব্দের প্রতিফলন, ভাঙ্গা বাক্যের প্রয়োগ, দৃশ্যপটের পরিবর্তনশীলতা, পরাবাস্তবতাবাদ পরবর্তীকালের অনেক সাহিত্যিককে প্রভাবিত করে। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তার লেখনীর কারণে তাকে অনেকদিন নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়। তার যে বইটিকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ধরা হয় তা হলো মেন অব মেইজ। এটি লাতিন সভ্যতা ও প্রাত্যহিক রীতিনীতির ওপর রচিত। এটিতে এমন এক রাজনৈতিক সমাজের রূপরেখা অঙ্কিত যেখানে মানুষের বিশ্বাস, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধারণা এমন এক জীবনে সঞ্চারিত যেখানে জীবনের ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্ববোধ একত্রিত। ১৯৬৬ সালে লেনিন পিস প্রাইজ পাবার পরের বছর তিনি সাহিত্যে নোবেল পান দ্বিতীয় লাতিন আমেরিকান হিসেবে। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মগুলো হলো, লিজেনডস অব গুয়াতেমালা, মিরর অব লিডা সেল।

            পাবলো নেরুদা কবি ও রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯০৪ সালে চিলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। গার্সিয়া মার্কেজ তাকে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে অভিহিত করেন। তার কবিতা প্রাণবন্ত ও আবেগপূর্ণ। লোরকার মতে নেরুদা একজন বিশিষ্ট কবি। শেষ বিচারে তাকে একজন চূড়ান্ত কবি বলতে হয়। পাবলো নেরুদা প্রথমে তার ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনী বৈধতা পায়। কৈশোরে তিনি এই ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ছদ্মনাম গ্রহণের পশ্চাতে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ছদ্মনাম গ্রহণ ছিল সে যুগের জনপ্রিয় রীতি, দ্বিতীয়ত - এই নামের আড়ালে তিনি তার কবিতাগুলো নিজের পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। তার পিতা ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। তিনি চাইতেন তার পুত্র কোন ব্যবহারিক পেশা গ্রহণ করুক। নেরুদা নামটির উৎস কবি ও রাজনীতিবিদ। নেরুদা নামটির উৎস চেক লেখক জান নেরুদা এবং পাবলো নামটির সম্ভাব্য উৎস পাল ভারলেইন। পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তার রচনা অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায় নেরুদার সাহিত্যকর্মে বিভিন্ন প্রকাশ শৈলী ও ধারার সমাবেশ ঘটেছে। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন- কুড়িটি প্রেমের পত্র ও একটি হতাশার গান- কামোদ্দীপনামূলক কবিতা সংকলন তেমনি রচনা করেছেন পরাবাস্তববাদী লেখা থেকে ঐতিহাসিক মহাকাব্য ও রাজনৈতিক ইস্তেহারও। এছাড়াও তার কবিতায় রাজনৈতিক সমালোচনা পাওয়া যায় তাই তাকে অনেকবারেই শাসকের কুনজরে পড়তে হয়েছে। ১৯৪৮ সালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তাকে এই সময় তার বন্ধুরা একটি ঘরের বেসমেন্টে লুকিয়ে রাখে। এরপরে নেরুদা পাহাড় পার হয়ে আর্জেন্টিনাতে গিয়ে আশ্রয় নেন।