ল্যাটিন আমেরিকান কবিতার রূপরেখা  (পর্ব - পাঁচ)


আরও দশজন লাতিন আমেরিকান কবি-
      
        লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের বয়স নেহাত কম নয়। বাচিক এবং লিখিত, দুই রূপ মিলিয়ে এ-সাহিত্যের বয়স পাঁচশ বছরের বেশি। এবং অবশ্যই সেটা কেবল হিস্পানি বা পর্তুগিজ ভাষায় রচিত হয়নি। স্বদেশি বা আদিবাসী নানান ভাষাতেও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য রচিত হয়েছিল এবং সেটি ছিল বাচিক। আশ্চর্য শোনালেও এ-কথা সত্য যে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে বাচিক ঐতিহ্যের ক্ষীণ একটি ধারা এখনো বহমান। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি বাংলাভাষীদের আগ্রহ যেন অনিঃশেষ এবং কিছুটা হুজুগপ্রবণও বটে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে এই সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রচনা, বিশেষ ক’রে উপন্যাস, ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ‘বুম’ [Boom] নামের প্রবল প্রপঞ্চ সৃষ্টি করার পর সেই আগ্রহের ঢেউ অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা থেকে বাংলাভাষী পরিসরও, সঙ্গত কারণেই, বাদ পড়ে নি। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের পাশাপাশি, প্রাক-কলম্বীয় যুগের কবি, দার্শনিক, যোদ্ধা ও স্থপতি নেযাহুয়ালকয়তাল [আনুমানিক ১৪০২-১৪৭২ সাল] থেকে শুরু ক’রে উপনিবেশিক যুগ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতক পেরিয়ে সমসাময়িক আলেয়দা কুয়েভেদো [জন্ম ১৯৭২, কিটো] অব্দি নানান লাতিন আমেরিকান কবি যে বিচিত্র ও সমৃদ্ধ কাব্যজগতের সৃষ্টি করেছেন তার পরিচয় পেতে বাঙালি রসনা উন্মুখ হয়েছে এবং কিছু অনুবাদকের সুবাদে—তাঁদের মধ্যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধায় অগ্রগণ্য—সেই রসভাণ্ডারের খানিকটা পরিচয় বাংলাভাষী পাঠক পেয়েছেন। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে রবার্ট ফ্রস্টের সেই নৈরাশ্যবাদী ও প্রতিহারীসুলভ মন্তব্য আমাদের মনে পড়ে গেলেও, সৌভাগ্যক্রমে অনুবাদকেরা তাতে কর্ণপাত করেন নি। অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তা আগলে রাখার চাইতে তাঁরা মনোযোগী হয়েছেন তাতে যা পাওয়া যায় তার সন্ধানে। তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ আমরা পাঠকেরা লাভ করেছি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতার পৃথক বাংলা অনুবাদ, সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে দুই মলাটের মধ্যে নানান কবির কবিতার সংকলন।

মোশতাক আহমেদ নিজে কবি হিসেবে যশস্বী, দীর্ঘ দিন ধ’রে তিনি কাব্যচর্চায় রত। তিনি বিশ্বকবিতা অনুবাদে ব্রতী হয়েছেন বছর দশেক আগে। উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়া থাকাকালীন-ই কাজটি শুরু করলেও এ-বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করেন ২০১১ সালে এবং তাঁর এই লাতিন আমেরিকান কবিতার অনুবাদ পরিক্রমা শুরু বছর কয়েক আগে। এখানে যে সাতজন লাতিন আমেরিকান কবির কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন—সিজার ভায়েহো [১৮৯২-১৯৩৮], মানুয়েল বানদেইরা [১৮৮৬-১৯৬৮], আলফোনসিনা স্তোর্নি [১৮৯২-১৯৩৮], হাভিয়ের আবরিল [১৯০৫-১৯৯০], রাফায়েল মেন্দেস দরিখ [১৯০৩-১৯৩৬], সালভাদোর নোভো [১৯০৪-১৯৭৪] এবং অক্তাভিও পাস [১৯১৪-৯৮]—তাঁদের মধ্যে প্রথম এবং শেষোক্ত কবির কবিতার অনুবাদ আমরা বাংলাভাষীরা প্রায়ই পেয়ে থাকলেও বাকি পাঁচজন-এর কবিতার অনুবাদ সহজলভ্য নয়, যদিও তাঁদের মধ্যে আলফোনসিনা স্তোর্নি যথেষ্ট খ্যাতিমান। এবং অক্টাভিও পাস ছাড়া তাঁদের প্রায় সবার জন্ম ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে বিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে। অর্থাৎ তাঁদের কাব্যকীর্তি লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যে পর্বটি বিখ্যাত ‘মদার্নিজমো’ [modernismo] নামে সুপরিচিত তার পরের সময়ের।

কবিতাগুলো নেয়া হয়েছে মূলত Dudley Fits সম্পাদিত Anthology of Contemporary Latin American Poetry’র ১৯৬৭ সালের সংস্করণ হতে, যদিও বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। নির্বাচিত কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু মৃত্যু, পলায়ন, ক্ষতি, অদম্য জীবন, প্রেম, প্রেমহীনতার বেদনা, প্রকৃতি, নিজ সংকল্পে অটল নারী, কবিতা, ইত্যাদি। কবি মোশতাক আহমেদ কবিতাগুলো ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমাদের জন্যে বাংলায় পরিবেশন করেছেন।

জি এইচ হাবীব

সিজার ভায়েহো
আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন দ্রষ্টা। নিজের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘এক প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে, বৃহস্পতিবারে’—ঘটেছিলও তাই! সিজার ভায়েহো [মার্চ ১৬, ১৮৯২-এপ্রিল ১৫, ১৯৩৮] ছিলেন পেরুনিবাসী কবি, নাট্যকার ও সাংবাদিক। জীবিতাবস্থায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হলেও স্বাতন্ত্র্যগুণে যে কোনো ভাষায় বিশ শতকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে তিনি বিবেচিত হন। সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে তিনি নিজেকে রাখতেন এগিয়ে। প্রকাশমাত্রই তাঁর তিনটি কবিতার বইই বৈপ্লবিক আবির্ভাব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। তবে নির্যাতন আর দারিদ্র্য সইতে হয়েছে কম না। কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে দান্তের পরে সবচেয়ে বড় বিশ্বজনীন কবি হিসেবে চিহ্নিত করেন।