কবিতার সঙ্গে সহবাস  (প্রথম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


(এক).

"কবি কোন তকমা নয়, কবি এক বিশেষ পরিচয়
মনের ভাব যার কথায়, ছন্দে চিত্রে প্রকাশ পায়।"
                                                     - কবিতা মিত্র।

                সব বিদ্যে শেখানো যায়, কবিতা লেখা শেখানো যায় না। ওটা যার হয় তার হয়, ভিতরের ব্যাপার (অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদ)। তবে আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি, চোখে পড়ে।
                কবিতা আসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে, ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না। কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করে, তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দিয়ে, সে নিয়ন্ত্রণে, কবিতা অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভিতরে কবিত্ব বোধ থাকলে তবেই হবে নতুবা সবটাই যাবে ফাঁকি।

         বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে অবশ্য , সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
সুনীল গাঙ্গুলী , সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখেরাও আশির দশকে কলকাতায় সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন , কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে , সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তারা কোন সৃষ্টিশীল কবি তৈরী করতে পারেননি দেখেই,  সেই পরিকল্পনা থেকে অচিরেই সরে আসেন ।

(দুই).

       দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস আমার, তবু কতটুকু বুঝতে বা জানতে পেরেছি তাকে? স্পষ্ট করে বলতে পারব না। সে আজও আমার কাছে সম্পূর্ণ রহস্যময়, আগের মতো সমান আকর্ষণীয়।
      তবু যতটুকু বুঝেছি তাকে, তা নিয়ে কিছু বলাটা বোধহয় অসমীচীন হবে না।
           অন্য কোন কবির, কবিতা লেখার পদ্ধতির কথা জানি না। তবে, নিজের লেখার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি, যা একান্ত ব্যক্তিগত, যদি কারও কোন উপকারে আসে, তাই বলা।
         আমি কোন কবিতা লিখি না, বরং কবিতাই আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয় , কেমন করে তাও বলি শুনুন।
        আচমকাই এক একটা পংক্তি কোথা থেকে এসে মাথায় ঢুকে পড়ে,  যার কোন রকম পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না।
          তারপর সেটা মনে মনে লালন করার পর্ব শুরু হয়, দ্বিতীয় পংক্তির জন্য প্রার্থনা চলে,
মনে মনে। সেটা কখন আসবে তা কেউ জানে না।
           আমি মনেকরি, কবিতা লেখা পার্টটাইম জব নয়, ফুলটাইম ওয়ার্ক। নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাপার, ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা থেকে শুরু হয় , তারপর ঘুমের আগে অবধি চলে কবিতা সৃজনের কাজ মনে মনে। ঘুমের ভিতরও অনেক সময় চলে স্বপ্নে।
          অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে,
হঠাৎ একটা পংক্তি এসে বিরক্ত শুরু করে, সকালে উঠে আর সেটা মনে থাকে না, তাই আমি তখনই সেই পংক্তিটি লিখে রাখার চেষ্টা করি আজকাল। হাতের কাছে যা পাই তাতেই লিখে রাখি তখনকার মতো, প্রেসক্রিপশনের উল্টো পিঠে, ক্যালেন্ডারের ছেঁড়া পাতায়,লন্ড্রির বিল, কিংবা কিছু কেনাকাটার রসিদ ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাই তাতেই।
       সকালে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সেরে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে,পংক্তিটি নিয়ে মনে মনে নাড়া চাড়া করি। আওড়াই বার কয়েক উচ্চারণ করে। ভিতরে ভিতরে কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় বলা চলে।
       সব সময় সফল হই তা নয়, প্রায়শই বিফল হই, কখনও সখনও সফলতা আসে তাঁর ( কার সেটা বলা মুশকিল) অনুগ্রহ পেলে। লেখাটা পূর্ণতা পায়। রাজশেখর বসু অবশ্য কবিতাকে, সরস্বতীর বরপুত্র বলেছেন। তাঁর কথা অনুযায়ী দাঁড়ায়, সরস্বতীর কৃপা।
         নিজের মনঃপূত না হলে, তার উপরও কাটাকুটি চলে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তুষ্টি আসে মনে।  এইভাবেই আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া চলে, বলা যায়।
          কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে , তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে, দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার, অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী, হঠাৎ ভূঁই ফোড়ের মতো কিছু হয় না।
ভাবতে হয় সে'সব লেখা নিয়ে নিয়মিত, দীর্ঘদিন এ'রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়। তারপর চলে নিজের মতো করে তার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ। সেটা মোটেই সহজ  ব্যাপার নয়।
      আমার মনেহয় হঠাৎ করে এসব আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। যারা এ'কথা বিশ্বাস করেন না, বা বোঝেন না, কিংবা মানেন না, তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া, তা' আর বেশী কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না।
       সে'রকম লেখাই আজকাল চোখে পড়ে বেশী , যাতে কোন প্রাণের সাড়া মেলে না।
মূর্তি গড়া হয় বটে, তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় না।
       কবিতা মানে তো তাই, যা সহজেই মানুষের চিত্তে চাঞ্চল্য ঘটায়, মনে করুণার উদ্রেক করে, নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে কিংবা বিরহকে করুণ সুরে মনে অনুরণন সৃস্টি করে এবং হিংস্র ক্রুদ্ধ যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা ও স্বস্তি এনে দেয়।
     মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়, আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে। আমার তো মনে হয় তাই। নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন, আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে, যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ'কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে, বহাল তবিয়তে। থাকবেও ভবিষ্যতে আশা করা যায়।
        এ'ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি।