কবি ও কবিতা
শংকর ব্রহ্ম

                                        
             ইংল্যান্ডের কবি টমাস গ্রে বলেছিলেন, 'কবিতা কখনও সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না। কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা ইঙ্গিতময়।'
             তিনি ভাবতেন, 'কবিতা হচ্ছে সুকুমার শিল্প, তাই সুকুমার শব্দই সে দাবি করে। অযোগ্য শব্দ কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়লে তাকে অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।'
           রবীন্দ্রনাথও প্রথমদিকে এই ভাবনার অংশীদার ছিলেন,পরে অবশ্য তাঁর কবিতায় নিত্য ব্যবহার্য হাঁড়ি’ ‘সরা’ থেকে শুরু করে ‘গুড়ের পাটালি’ ‘ঝুনা নারিকেল’ শব্দের উল্লেখ ঘটেছে।
           ওয়ার্ডসওয়র্থ আবার বলেছেন উল্টো কথা, 'সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত, যা মানুষের মুখের ভাষা।' শঙ্খ ঘোষ একেই বোধহয় বলেছেন, বাকছন্দ।
            আনন্দ বর্ধন বলেছেন, 'যে-বাক্যবদ্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের লভ্য নয়, কাব্য বলে গণ্য হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই।'
            ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
'কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলেন,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।'
              শুধু নিজের সঙ্গেই যদি কথা বলেন, পাগলের সঙ্গে তার বিশেষ তফাৎ থাকে না। পাগল নিজের সঙ্গে কথা বলেই তার কর্তব্য সম্পাদন করে। তবে কবিকে কথাগুলি লিখে রাখতে হয়। কেন লিখে রাখতে হয়? কাউকে শোনাবার জন্যই তো?
           কবিতায় কবি কথা বলেন। সেই কথা পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে তাকে আশ্রয় নিতে হয় উপমা, চিত্রকল্প, ছন্দ, রূপক, উৎপ্রেক্ষণ, ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
                    কবিতায় পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে, পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামেে মধ্যে প্রবেশের। পাঠকরা পড়ে যদি কিছুই না বুঝতে পারে, তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
       এই প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে  রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের কথা মনে পড়ছে।
         সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, 'পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দ-বাধায় ঠোক্কর খেয়ে,অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে, কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে, তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে, কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়ক।    
         উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য, একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল। কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটা হলেই ভালো। সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক। যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
       ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্রসারিত হচ্ছে।
       এই "বিশেষ জ্ঞানে"-র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে, সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।'
             রবীন্দ্রনাথের অবশ্য এ'মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন,
'মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর। বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন, ব্রার্টান্ড রাসেল, প্রশান্ত মহালনবিশ, সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত সব লোক।'
         অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এই বোধ তার তীব্রভাবে ছিল। তার ভাষায়,'আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না।'
       কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
'কাব্যে কল্পনার ভিতর, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।'
     কবির যেমন চিন্তা ও চেতনারএক নিজস্ব জগৎ আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাও তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে, এবং কবি তা প্রকাশ করেন, তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে। কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে, সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর। তাঁর মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা, প্রিয় কবির প্রভাব, পারিপার্শিক পরিস্থিতি, সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
          সেটা এমন রহস্যময় কুহেলিকা, যা কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারেন না।
        
           জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন,
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’
             ‘নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল ব্রহ্মময়ী! কী অপরূপ শব্দ দ্যুতি-দীপ্ত!
কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। নতুন অর্থ-বলয় তৈরি করে হয়ে উঠল অসামান্য। এমন-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাবনা অনুযায়ী, 'তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।'
              শব্দ যখন শক্তিমান রূপ-তপস্বীর হাতে না-পড়ে, কোনও আনাড়ি খোদাইকরের হাতে পড়ে, তা হয়ে ওঠে শব্দের জঞ্জাল। তিনি হয়ে উঠেন 'শব্দ-দাস' কিংবা 'শব্দ-দানব'।
                আবার সফল কবিকে 'শব্দের সাথে শব্দের বিয়ে'র আয়োজন শেষে তাঁকে দেখায় আত্মবিশ্বাসী ঘটকের মতো। যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে কবিতার একমাত্র মার্গ-সাধনার পথ, আর নতুন লিখিয়েরা ভেবে নিচ্ছে, এটাই উত্তরণের পথ। এভাবে চলছে অচ্ছেদ্য এক দুষ্টু-চক্র।

            তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’-এর শুরুতেই যে প্রশ্ন করেছিলেন, সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে করা যায়, ‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’
              বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো, একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয়! ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’
        শব্দে ব্যুৎপত্তি থাকলে, অকবির পক্ষেও সাজানো কবিতা নির্মাণ করা অসম্ভব নয়। বর্তমানে তারই প্রকাশ বেশি দেখা যায়,যাতে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না।      
                       কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায় ,
'শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়। কবিতায় কথাই (শব্দ) সব। কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে। কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না। শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা। কেননা, শব্দই হল কবিতার মূলাধার।'
                   মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিতার কথা বলতে গিয়ে একেই বলেছেন, ' শব্দে শব্দে বিবাহ বন্ধন।' বিবাহ বন্ধন সুন্দর হলে যেমন সংসার সুখের হয়ে ওঠে , তেমনি শব্দ ও শব্দের মিলন সুন্দর হলে, কবিতাও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।বস্তুতঃ,শব্দ বাছাইয়ের উপর নির্ভর করে,তার পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়। মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কোন কোন কবি জ্যান্ত করে তুলতে পারেন। অবশ্য সকলে নয়। সেজন্যই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন,
' সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।'
      যথার্থ কবির কাছে শব্দের খেলাই হয়ে ওঠে কবিতা, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
       তার জন্য প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " কঠিন সাধনার"।
   অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই মহৎ কাজ কখনই করা সম্ভব নয়, বলে আমার বিশ্বাস।