হৃদয় ছেঁড়া ব্যথা
শংকর ব্রহ্ম
কাজী নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশটা বছর ছিল বড় মর্মান্তিক । তাঁর মতো সৃষ্টিশীল মানুষ কত অবহেলা আর বঞ্চনার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন যা বেদনাদায়ক। কেউ কেউ বলেন, নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে (৭ই আগস্ট ১৯৪১) কলকাতা রেডিওতে ‘রবিহারা’ কবিতাটি ঐ দিনই লিখে আবৃত্তি করার সময় তাঁর কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসে, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তার একবছর পর ১০ই জুলাই নজরুল তাঁর সুহৃদ জুলফিকার হায়দারকে লিখেছিলেন - “তুমি এখনি চলে এসো ... কাল থেকে আমি অসুস্থ”। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি ১৯৪২ এর ৯ই অগষ্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবি তখন আক্ষরিক ভাবেই কপর্দকশূন্য। সংসারে দুই শিশু পুত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রী প্রমীলা, সর্বক্ষণের অভিভাবক শাশুড়ি গিরিবালা। ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফার করেও গ্রামোফোন কোম্পানী তার কোন রয়ালটি দেননি, তাঁর লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাননি। ১৭ই জুলাই ১৯৪২, শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে কবি তার এক বন্ধুকে লেখেন, “আমি blood pressureএ শয্যাগত, অতিকষ্টে চিঠি লিখছি। আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারদের তাগাদা, প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের worries ৩/৪মাস পর্যন্ত। এইসব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে। ... কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু’একটা কথা বলতে পারি, বললে যন্ত্রণা হয় সর্ব শরীরে”।
কবির অসুস্থতার কারণ বা কি ছিল তাঁর অসুখ? শোনা যায় ‘নবযুগ’ সম্পাদনা কালে একবার কবি উত্তরপাড়ায় এক দুষ্কৃতি দলের কাছে প্রহৃত হয়েছিলেন,তাঁর ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত লাগে। এই আঘাতের কথা কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। শোনা যায় নির্বাক কবি যখন বাংলাদেশে (১৯৭২), তখন নাকি তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড, কবির ঘাড়ে পুরাতন কঠিন আঘাতের চিহ্নটি সনাক্ত করেছিলেন ।
বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় - কী নিদারুণ অ-ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর অসুস্থতা প্রকট হওয়ার পর । প্রথম সাতদিন চিকিৎসা করেন হোমিওপ্যাথিক মতে, নজরুলেরই বাড়িওয়ালা ডাক্তার ডি এল সরকার । অথচ মাত্র তিনদিন চিকিৎসার পর অতি উৎসাহী হয়ে নজরুলের সেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে কবির অসুস্থতার সংবাদ পাঠিয়ে দিয়ে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেন বলে । বাইশ বছর পরে লেখা তাঁর গ্রন্থে (‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় – ১৯৬৪) জুলফিকার হায়দার এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সাফাই দিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘হয়তো অসুখের সংবাদ পেয়ে কাজীদার অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ভক্ত অনুরক্তদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যাবে, দেখতে আসবে’ । অথচ জুলফিকার হায়দার প্রচারিত কবির ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’র মিথ্যা সংবাদ প্রচারের দুই বছর পরেও ১৯৪৪এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি একজন নুরুল ইসলামকে একটা কাগজে লিখে নজরুল জানিয়েছিলেন - “শ্রীমান মোহম্মদ নুরুল ইসলাম, তুমি চিরঞ্জীব হয়ে থেকো । আমায় ও আমার ছেলে দু'টিরে চিরদিন মনে রেখো”।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হল ১৯৪২এর ১৯শে জুলাই, কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাবার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১শেসেপ্টেম্বর । ১৯৪৪এর ২৪শে মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটি আবেদন প্রচারিত হয় । আবেদনে বলা হয়েছিল ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুদিন যাবত পক্ষাঘাতে শয্যাগত। তিনি এখন নিঃস্ব ও কপর্দকহীন । তাঁহার স্ত্রীও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়িনী। চিকিৎসা তে দূরের কথা, এমন সঙ্গতি নাই যে শিশু পুত্রদ্বয়, রুগণা পত্নী ও নিজের আহার্যটুকু তাঁহার জোটে। বাংলার জাতীয় কবির প্রাণ রক্ষায় সহৃদয় সর্বসাধারণের অকুন্ঠ সাহায্য একান্ত আবশ্যক’।
এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকে দেখেন একাধিকবার, কিন্তু নিরাময়ের কোন লক্ষণ দেখা যায় না । কবি কাজী আবদুল ওদুদের উদ্যোগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগে কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয় ১৯৫২র ২৫শে জুলাই। কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোন উন্নতি না হওয়ায় ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায়। পরের বছর ১০ই মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। সেখানকার চিকিৎসকেরা মত প্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মষ্টিস্কের সংকোচন হয়েছে । লন্ডন থেকে ১০ই ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায় । সেখানেও চিকিৎসকের অভিমত ছিল বড় দেরী হয়ে গেছে, কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না । এরপরেও পূর্ব জার্মানীর বন বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন। তাঁরও অভিমত ছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে। সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩’র ১৪ই ডিসেম্বর।
এর পরেও ২৩বছর জীবিত ছিলেন নজরুল। অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া, অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনের সঙ্গী । পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুইবাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল । ১৯৬২র ২৩শে জুন দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান হ’ল, কবি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন ।
জীবনের শেষ চারটি বছর কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় তাঁর প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন । মৃত্যুর সাত ঘন্টার মধ্যেই তাঁর আপনজনের উপস্থিতির আগেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নীরব কবিকে সমাহিত করলেন সে দেশের সরকার।
[ঋণ স্বীকার - বাঁধন সেনগুপ্ত।]