গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ও তাঁর কবিতা  (প্রথম পর্ব)
(ল্যটিন-আমেরিকান কবি)
শংকর ব্রহ্ম


               আমাদের অনেকের কাছে 'গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল' কবি হিসাবে বহুল পরিচিত নাম নয়। অনেকেই তার কবিতা পড়েননি। তাদের কথা ভেবেই, তাঁর সম্পর্কে খানিকটা অবহিত করার জন্যই এই নিবন্ধের অবতারণা।

         পৃথিবীতে খুব কম কবি আছেন যাদের ছবি কোন মূদ্রায় ছাপা হয়েছে। চিলির নোবেল বিজয়ী নারী কবি গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের মুখটা দেখা যায় সে দেশের ৫০০০ পেশোর নোটে। নোবেল পুরস্কার কমিটি তার সম্পর্কে বলেছে, ‘‘তার নামটিই সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার আদর্শগত অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছে।’’ তিনি ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি। তিনি আমেরিকার চারটি কলেজে স্প্যানীয় সাহিত্য নিয়ে পড়িয়েছেন। কবি হিসাবেই শুধু নয় চিলির ইতিহাসে তিনি একজন শিক্ষাবিদ, কূটনৈতিক, নীতি নির্ধারক, নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় একাগ্র কর্মী হিসাবে অমর হয়ে আছেন। আজও তার নামে পরিচালিত ফাউন্ডেশন অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে অকাতরে।
             গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল, সেই সময়ের অন্যতম কবি ছিলেন যারা তাঁর কবিতায় বাস্তবতা, দৈনন্দিন বাস্তবতা আবিষ্কার করার চেষ্টায় সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং ঘনিষ্ঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
             গ্যাব্রিয়েলা, যিনি ১৯৪৫ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন "মৃত্যুর সনেটস", তাঁর অন্যতম সেরা এবং উল্লেখযোগ্য কাজ।
এটি দ্বারা অনুপ্রাণিত রোমেলিয়ো উরেটার আত্মহত্যা, তার পুরানো ভালবাসা।
             গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল প্রেমে পড়েছিলেন। সতেরো বছর বয়সে। প্রেমের বয়স তিন বছর হতে না হতেই আত্মহত্যা করলেন প্রেমিক যুবক রোমিও উরেতো। মৃত্যুর সময় তার পকেটে মিস্ত্রালের লেখা একটি চিঠি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। রোমিও চলে গেলেন মিস্ত্রালের সমূহ আবেগকে ভূমিকম্পের মতো নাড়া দিয়ে। হৃদয়ে সুপ্ত যে কবিতার আগ্নেয়গিরি, মিস্ত্রাল তার উদগিরণ ঘটালেন ‘মৃত্যুর সনেট’ কাব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এরপরই তার জীবনে নেয় এক নাটকীয় মোড়। লাতিন আমেরিকা তথা পুরো দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দেন তার কবিতার শৈলী দিয়ে। প্রথম লাতিন কবি হিসেবে নোবেল পুরস্কারের পাশাপাশি অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেন এই কবি ও শিক্ষাবিদ।
       মিস্ত্রালের সাথে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি বিষয়ে দারুণ সাদৃশ্য ছিল। হেমিংওয়ে স্বীকার করেছিলেন, প্রতিটি লেখাকে তিনি বারবার সংশোধন করতেন। তার দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি  উপন্যাসের শেষ অংশটি ছাপা হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মোট ছত্রিশ বার সংশোধন করেছিলেন। মিস্ত্রালও তার লেখার উৎকর্ষতার ব্যাপারে ছিলেন আপোষহীন। লেখা শেষ করার পর সেটিকে তিনি বারবার সংশোধন করতেন। যখন সেটিকে প্রকাশ উপযোগী মনে হতো, শুধুমাত্র তখনই সেটিকে ছাপতে দিতেন।
আজকালকার লেখকদের কাছে এটা একটা শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে। তিনি প্রায় আট'শ কবিতা লিখেছিলেন, অথচ জীবদ্দশায় ছাপতে দিয়েছিলেন মাত্র ৩৭৯টি। অর্ধেকেরও কম।  অবশিষ্ট কবিতাগুলো প্রকাশের যোগ্য মনে না হওয়ায় তিনি সেগুলো ছাপতে দেননি। অবশ্য পরবর্তী কালে তাঁর মৃত্যুর পর  সে'সব কবিতাগুলি আর অপ্রকাশিত থাকেনি।
     কবি যেটুকু প্রত্যক্ষ করেন, ধারণ করেন অন্ত্রে ও তন্ত্রে,  কলমের কালিতে অঙ্কন করেন তারই প্রতিরূপ। জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা স্থান করে নেয় তার কবিতার বিষয়বস্তুতে। প্রকৃতি, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, মাতৃস্নেহ, দুঃখবোধ এবং তা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে তার কবিতার অনুসঙ্গ। তিনিই প্রথম দেশীয়, আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান প্রভাবের মিশ্রণের কবিতাকে বিশ্বের সাথে পরিচিত করে তোলেন। যাদের হাত ধরে লাতিন কবিতা আধুনিকতার যুগে প্রবেশ করে মিস্ত্রাল তাদের অন্যতম। পাবলো নেরুদা কৈশোরে মিস্ত্রালের কবিতা দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিলেন। নেরুদা অবশ্য সে'কথা অকপটে স্বীকারও করেছিলেন।    
          নেরুদার মতো লাতিন আমেরিকার অনেক আধুনিক কবিরই রোল মডেল ছিলেন মিস্ত্রাল।
           কবিতা লেখার অপরাধে সেকেন্ডারি স্কুলে পড়তে দেয়া হয়নি মিস্ত্রালকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের ভয় ছিলো, জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারেন এবং যীশুর প্রতি তার আস্থা হারিয়ে যেতে পারে। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঘরে তার শিক্ষিকা বোনের কাছে পড়াশোনা করতে হয়েছিল। অথচ উপেক্ষিত মিস্ত্রালই একদিন চিলির জাতীয় শিক্ষক হয়েছিলেন এবং চিলি, মেক্সিকোসহ অসংখ্য দেশের শিক্ষার পলিসি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি শৈশবে শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত হয়েছিলেন, পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাই শিশুদের বঞ্চনায় তিনি মর্মাহত হতেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য, উৎসাহিত করেছেন চারপাশের মানুষকে। তিনি বলতেন, ‘শিশুর কল্যাণে কিছু করবার উদ্দেশ্যে আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করা উচিৎ নয়, আগামীকাল খুব কাছাকাছি নয়, সেটা অনেক দূরে, যা করার তা আজই শুরু করতে হবে, এখনই, এই মুহূর্তেই।’
      তরুণ প্রেমিকের মৃত্যুর পর জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে আর কোনো পুরুষের সাথে সখ্য গড়ে ওঠেনি মিস্ত্রালের। বিয়ে না করলেও লালন করতেন 'ইয়েন' নামের এক পালক শিশুকে। বিশ বছরের ইয়েন একদিন আর্সেনিক খেয়ে আত্মহত্যা করে। এতে খুব ভেঙে পড়েন মিস্ত্রাল। তিনি এটিকে আত্মহত্যা হিসেবে কখনোই বিশ্বাস করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর  বিরুদ্ধবাদীরা তার সন্তানকে হত্যা করেছে।  
       ইয়েনের মৃত্যুতে তিনি এতোটা ঘোরের মধ্যে চলে যান যে, তিনি বাস্তবতার পাশাপাশি এক ঘোরের জগতেও বসবাস করতে শুরু করেন। এরপর থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এর কিছুদিন পর প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ত্যাগ করে চলে যান।      
        গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের জন্ম ১৮৮৯ সালে, চিলির ভিকুনায়। প্রকৃত নাম লুসিয়া গড়োই আলকাইয়াগা। তিনি লাতিন আমেরিকার প্রথম নোবেল বিজয়িনী। ব্যর্থ প্রেম এবং গভীর মাতৃত্বের অনুভব তাঁর কবিতার মূল প্রবাহ।  ১৯৫৭ সালে এই বিদূষী  নারীবাদী কবি ও প্রজ্ঞাময়ী শিক্ষাবিদের জীবনাবসান ঘটে।