গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ও তাঁর কবিতা  (দ্বিতীয় পর্ব)
(ল্যটিন-আমেরিকান কবি)
শংকর ব্রহ্ম


গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কয়েকটি কবিতা -

     "মৃত্যুর সনেটস", দ্বারা অনুপ্রাণিত রোমেলিয়ো উরেটার আত্মহত্যা, তার পুরানো ভালবাসা। এবং প্রথম সনেটি এরকম : -

১).

" পুরুষরা আপনাকে যে হিমশীতল কুলুঙ্গি দিয়েছিল তা থেকে,
আমি তোমাকে নীচু এবং রৌদ্রোজ্জ্বল দেশে নামিয়ে দেব।
এতে আমার ঘুমোতে হবে যে পুরুষরা জানত না,
এবং আমাদের একই বালিশে স্বপ্ন দেখতে হবে।

আমি তোমাকে একটি দিয়ে রোদে পৃথিবীতে শুয়িয়ে দেব
ঘুমন্ত ছেলের প্রতি মায়ের মিষ্টি,
এবং পৃথিবীকে দোলনা কোমলতায় পরিণত হতে হবে
আপনার শরীরে ব্যথা হওয়া শিশু হিসাবে

তারপর আমি ময়লা এবং গোলাপ ধুলা ছিটিয়ে দেব,
এবং চাঁদের নীল ও হালকা ধুলায়
হালকা ভাবে বন্দী করা হবে।

আমি আমার সুন্দর প্রতিশোধ গেয়ে চলে যাব,
কারণ সেই লুকানো সম্মানীর কাছে এর হাত
আপনার মুষ্টিমেয় হাড়গুলি বিতর্ক করতে নেমে আসবে!

২).

যারা নৃত্য করে না

‘‘এক পঙ্গু শিশু
বললো, ‘‘আমি কী করে নাচবো?’’
তোমার হৃদয়কে নাচতে দাও
আমরা বললাম।

অতঃপর সেই অচল বললো :
'‘আমি কী করে গাইবো?’’
তোমার হৃদয়কে গাইতে দাও
আমরা বললাম
অতঃপর কথা বললো নিঃস্ব মৃত কাটাগাছ
‘‘কিন্তু আমি, আমি কী করে নাচবো?”
তোমার হৃদয়কে বাতাসে উড়তে দাও
আমরা বললাম।

অতঃপর উর্ধ্ব থেকে ঈশ্বর কথা বললেন
‘‘আমি কেমন করে এই নীল থেকে অবতরণ করবো?’’
আসুন আমাদের জন্য নাচুন এইখানে এই আলোতে

আমরা বললাম।
সকল উপত্যকা নেচে উঠছে
একত্রে এই সূর্যের নীচে
এবং তারহৃদয় যে আমাদের সাথে যোগ দেয়নি
ধুলাতে পরিণত হচ্ছে, ধুলা থেকে ধুলাতে।’’

৩).

বিষন্ন মা

" ঘুমাও, ঘুমাও, আমার প্রিয়তম
কোন উদ্বেগ ছাড়া, কোন ভীতি ছাড়া,
যদিও আমার আত্মা ঘুমায়না,
যদিও আমি বিশ্রাম নিই না।

ঘুমাও, ঘুমাও, এবং রাত্রিরে
তোমার ফিসফিসানি কোমল হোক
ঘাসের পাতার চেয়েও,
অথবা রেশমী ভেড়ার লোমের চেয়েও।
আমার এই কায়া তোমার ঘুমে মিলাক,
আমার উদ্বেগ, আমার কম্পন।
তোমার মধ্যে, আমার চোখ বন্ধ হোক
এবং আমার হৃদয় নিদ্রা যাক।

আমার মাংসমজ্জা মিশে যাক তোমার শরীরে
থেমে যাক উদ্বেগ, বুকের কম্পন
তোমাতেই ডুবে যাক আমার চক্ষুদ্বয়
আমার হৃদয়, সেও ঘুমিয়ে যাক তোমার ভিতর। "

৪).

আমি একা নই

‘‘এই রাত্রি, সে তো জনশূন্য
পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত
কিন্তু আমি, যে তোমাকে দোলা দেয়
আমি তো একা নই!

এই আকাশ, সে তো জনশূন্য
চাঁদের ঝরণা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত
কিন্তু আমি, যে তোমাকে ধারণ করে
আমি তো একা নই!

এই বিশ্ব, সে তো জনশূন্য
দেখো, সকল জৈবদেহ বিষন্ন
কিন্তু আমি, যে তোমাকে জড়িয়ে ধরে
আমি তো একা নই!’’

৫).

" গোধূলি
আমি টের পাচ্ছি আমার হৃদয় গলে পড়ছে
নরম মোমের মত গলে পড়ছে
আমার শিরা উপশিরা তেলের মত ধীরে বহমান
এবং একেবারেই মাতাল নয়,
আমি ছুঁতে পারছি আমার অনুভব
টের পাচ্ছি, শান্ত অচঞ্চল হরিণীর মতো
পালিয়ে যাচ্ছে জীবন।

৬).

শিল্পীর জন্যে দশ আদেশনামা -

১). তুমি অবশ্যই সুন্দরকে ভালবাসবে;
সুন্দর হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের ওপর ঈশ্বরের ছায়া।
২). ঈশ্বরহীন কোনো শিল্প নেই।
তুমি স্রষ্টাকে ভালো না বাসলেও তাঁর প্রতিরূপ সৃষ্টি করে তাঁর সাক্ষী হতে পার।
৩). তুমি সুন্দরের স্রষ্টা হবে,
কিন্তু তোমার সৃষ্ট সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ভোগের জন্যে নয়, আত্মার পুষ্টির জন্যে নিবেদিত হোক।
৪). কখনো সুন্দরকে বিলাসিতা ও অহংকারের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করো না, তাকে বরং আধ্যাত্ম নিবেদনের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার কর।
৫). কখনও আনন্দোৎসব বা মেলায় সুন্দরকে খুঁজতে যেয়ো না; সেখানে তোমার শিল্পকেও উৎসর্গ করো না, কারণ সৌন্দর্য কৌমার্যও বটে এবং তাকে আনন্দোৎসব বা মেলায় পাওয়া যায় না।
৬). সুন্দরের উত্থান হবে তোমার অন্তর থেকে সংগীতের রূপ ধরে এবং তুমি তাতে প্রথম পরিশুদ্ধ হবে।
৭). তুমি সুন্দরকে এমনভাবে সৃষ্টি কর তা যেন করুণার প্রতিমূর্তি হয় এবং মানুষের হৃদয়কে সমবেদনায় ভরে দেয়।
৮). মা যেমন নিজের রক্ত থেকে, অন্তর থেকে সন্তানের জন্ম দেয়, তুমিও শিল্পের জন্ম দেবে সেভাবে।
৯). সুন্দরকে ঘুম-পাড়ানো আফিমের মতো নিয়ো না, সুন্দর হবে কড়া মদের মতো , যা তোমাকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করেবে। তুমি যদি যথার্থ পুরুষ বা যথার্থ নারী হতে ব্যর্থ হও, তবে তুমি শিল্পী হতেও ব্যর্থ হবে।
১০). প্রতিটি সৃজনকর্মের শেষে নিজেকে বিনয়ী কর, কারণ তোমার সৃষ্টি কখনও তোমার স্বপ্নের মতো মহৎ নয় এবং তা অবশ্যই ঈশ্বরের সবচেয়ে অসাধারণ স্বপ্ন প্রকৃতির চাইতে নিকৃষ্ট।

৭).
সহোদরা

আজ লাঙলের ফলায় ভূমি কর্ষণরত এক রমনীকে দেখলাম
তার ছিলো প্রণয়গ্রাহী চওড়া নিতম্ব, আমার মতোন
আর সে ঝুঁকে ঝুঁকে একমনে কাজ করছিলো।
সযত্নে আমি তার কোমরে হাত রাখি , তাকে নিয়ে আসি বাড়ি।
সে আমার নিজস্ব গ্লাস হতে দুগ্ধপান করে,
পোহায় ভালোবাসার ছোঁয়ায় বাড়ন্ত ফলবর্তী কুঞ্জবনের ছায়া।
আর আমার স্তন যদি অনুর্বর হয়ে উঠে;
আমার সন্তান ঠোঁট রাখবে তার দুধালো স্তনে।
------------------------------------------------------
[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত। ঋণস্বীকার- উইকিপিডিয়া ]
কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার -
১). মুম রহমান
(লেখক ও কবি।)
২). অনুবাদক - রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়।