ধ্রুপদী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম



                    কবিতা লেখার প্রধাণতঃ দুটি ধারা লক্ষনীয় :
কবিদের অধিকাংশই আবেগ-প্রবণ ধারার বাহক। অন্য ধারাটি ক্ষীণতনু বুদ্ধিগ্রাহ্য ধারা, যাদের বাহক- মাইকেল মধুসূধন দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখ কবিরা।
            কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যে হেতু বুদ্ধি কর্ষিত ধারার লেখক। ফলতঃ আবেগ বর্জন তার প্রথম কর্তব্য বলে মনে করেছেন, তিনি জানিয়েছেন, 'আমি মরমী প্রাগলভ্যের জাত-শত্রু।
     .... এমন কোনাে ভাব বা আবেগ নেই, যা কায়মনােবাক্যের সহযােগ ব্যতিরেকেও, কেবল কাব্য রচনার উপযােগী।'
      তিনি মনে করতেন, 'কবিতা শুধু আবেগ নির্ভর নয়, কাব্যাবেগকে মনস্কচর্চার মাধ্যমে, প্রকাশ যােগ্য করে তুলতে হবে। তিনি বলতেন, 'বর্তমানের সহিত সাধনা যে নৈরাত্ম সিদ্ধির রূপ অভাবেই ধ্রুপদী পদবীর অযােগ্য এবং ইদান্তীন্তন বিদগ্ধ সমাজ যে আনুপূর্বিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই সময়ােচিত রস গ্রহণে অক্ষম এমন একটা স্বতােবিরােধী বিশ্বাস আমার মনে বদ্ধমূল। তিনি বলতেন, 'কাব্য কবির পূর্বপুরুষ, কবি কাব্যের জন্মদাতা নয়। প্রথম কবিতার আবির্ভাব হয়েছিল কোনও ব্যক্তি বিশেষের মনে নয়, একটা মানব সমষ্টির মনে।
      প্রথম কবিতার প্রসার শুধু একটি মানুষের উপর নয়, সমগ্র জীবনের উপর ; প্রাথমিক কবিতার উদ্দেশ্য বিকলন নয়, সঙ্কলন।
       প্রেরণা নামক কোন অলৌকিক শক্তিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, 'রূপ আর প্রসঙ্গের পরিপূর্ণ সঙ্গমেই কাব্যের জন্ম।'
         তাঁর মতে, 'নির্ব্বিরোধ ন্যায়ের নিত্য আদর্শই
মহান কাব্যের প্রধান উপজীব্য।'

          তিনি (কবি সুধীন্দ্রনাথ দ্ত্ত) ছিলেন, সুদর্শন। প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বনেদী ঘরের সুসন্তান। গভীর চিন্তাধারার অধিকারী। মননশীল শ্রোতা এবং পাঠক। তাঁর যােগ্য সহধর্মিনী ছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত সাম্রাজ্ঞী রাজেশ্বরী দত্ত। পিতা ছিলেন তাঁর হীরেন্দ্রনাথ দ্ত্ত।
          জন্ম তাঁর  ১৯০১ সালের ৩০শে অক্টোবর। ১৯৬০ সালের ২৫শে জুন তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
         সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বেশী বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই 'তন্বী’  (১৩৩৭ বঙ্গাব্দে) তাঁর উনত্রিশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছিল।
         বুদ্ধদেব বসুর কাছে জানতে পারি 'সুধীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনে, বাংলা ভাষা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিল না। তাঁর বাল্যশিক্ষা ঘটেছিল কাশীতে, তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি ভালভাবে শিখেছিলেন, কিন্ত্র বাংলা চর্চার তেমন সুযােগ পান নি।'
         তাঁর নিজের আগ্রহ ছিল ইংরেজি, মার্কিন, ফরাসী ও য়ুরােপীয় কবিদের প্রতি। তাঁরাই তাঁর কাব্যের আদর্শ ছিল। 'সংবর্ত' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, মার্লার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট : আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ।
     তাঁর সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রতি তিনি তেমন আগ্রহ বােধ করেন নি।
     তাঁর অগ্রজ কবি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তিনি বিষ্ণু দের ‘চোরাবালি' পড়ে তাঁর লেখার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
      তা ছাড়া তার মতে বুদ্ধদেব বসুর মতাে সাবলীল লেখক এ-দেশে বেশি জন্মায়নি।'
   কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কবি জীবনানন্দ দাশ কিংবা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার প্রসঙ্গে তাঁর কোন রকম অভিমত আমরা পারিনি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো,  তার মতাে বিষ্ণু দে এবং বুদ্ধদেব বসুও বিশ্ব-সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন।
      মধুসূদনের মতাে তিনিও প্রচলিত বাংলা কাব্য রীতিতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাই তিনি বাংলা কবিতার প্রবাহমান ঐতিহ্যে, যুয়োরোপীয় আধুনিকতার সঞ্চার করতে, মধুসূদনের মতােই উদ্যোগী হয়েছিলেন। মধুসূদনকে, ভারতচন্দ্রের গ্রাম্যতা দোষযুক্ত রসঘন কবিতা, তৃপ্তি দিতে পারে নি। যেমন সমসাময়িক কবিরা সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে পরিতৃপ্ত করতে পারেন নি। কাব্য রচনায় মধুসূদনের মতাে তাকেও প্রচুর সময় দিতে হয়েছিল, কবিতার সমসাময়িক প্রচলিত রচনারীতিকে অগ্রাহ্য করে, বিকল্প শব্দ ব্যবহারে।