ধ্রুপদী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত - (ষষ্ঠ পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


              স্পষ্ট কোনাে রাজনৈতিক বিশ্বাস সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় ধরা পড়েনি। তিনি যেমন হিটলারের শাসনে শঙ্কিত, তেমনি স্ট্যালিনের উখানেও উদ্বিগ্ন।

           যযাতি' কবিতায় তিনি বলেছেন -

"আমি বিংশ শতাব্দীর
সমান বয়সী ; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে, বীর
নই, তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তরে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে
যত না পশ্চাৎপদ, ততােধিক বিমুখ অতীতে।"

কিংবা –

"তবু জানি যবে জয় হবে বলেছিলে
চাওনি তখন তুমিও এ-পরিনাম :
শূন্যে ঠেকেছে লাভে লােকসানে মিলে,
ক্লান্তির মতাে, শান্তিও অনিকাম,
এরই আয়ােজন অর্ধশতক ধ'রে,
দু-দুটো যুদ্ধে, একাধিক বিপ্লবে
কোটি কোটি শব পচে অগভীর গােরে,
মেদিনী মুখর একনায়কের স্তবে !"

                 সমসাময়িক কবিকুল, যখন দেখি, জনপ্রিয়তায় উদগ্র লালচে প্রচারের আলােয় উদ্ভাসিত হবার জন্য যতটা উদ্গ্রীব, সৃজনের ব্যাপারে ততটা যত্নশীল নন। তখন আশ্চর্য লাগে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জনপ্রিয়তার মােহ সযত্নে বিষবৎ পরিত্যাগের পরিকল্পনাকে।

                  এইসব জেনে বুঝেই কী জনপ্রিয় কবি জয় গােস্বামী বলেন -

'তার যে কী হবে আমি জানি না।
সে তাে কবি বেশী কিছু জ্ঞানী না।'

                   এমন কথা কেউ ভাবতে পারেন, মনে করেই বােধহয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন,
"কবিদের কান্ডয় জনসাধারণ যতই হাসুক না কেন, তবু তার সম্বন্ধে কিংবদন্তীর অন্ত নাই। এই রূপকথাগুলাের মধ্যে যেটা সবচেয়ে দুর্মর ও রহস্যময়, সে হচ্ছে প্রেরণা নামক এক অলৌকিক শক্তি। যারা কবিতা লেখেন না, শুধু পড়েন, যারা লেখা, পড়া কিছুরই ধার ধারেন না, তারা যদি ভাবেন যে কাব্যরচনার জন্য বিদ্যা-বুদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা, সাধনা-সংযম, এ সমস্তই অনাবশ্যক, প্রয়ােজন শুধু অখন্ড অবসর আর অপার দৈবানুগ্রহ, তবে প্রতিবাদ করে লাভ নেই।"

                 কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা, পাঠকের কাছে, দুর্বোধ্য বা দুরূহ মনে হলেও, তাঁর কবিতায় একটিও উদ্ভট বা অসংলগ্ন শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
                 যদি কেউ বারবার তার কবিতা পড়েন, শব্দের অর্থ বুঝবার জন্য অভিধানের সহায়তা গ্রহণ করেন, তবে তিনি তার (সুধীন্দ্রনাথ দত্তের) কবিতার রস গ্রহণে সক্ষম হবেন, তাঁর কবিতা পাঠে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। এ কথা আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
                  সামগ্রিক ভাবে, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, আধুনিক বাংলা কবিতার আসরে- বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র এবং অভিনব, এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মেধা-মনীষা এবং সচেতন কারুকৃতির অন্যতম পথিকৃত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পরিশেষে স্বীকার করি, যদিও আমি তার অনুগামী (যারা তাঁর মতো লিখতে চান) নই, তবুও তাঁর কাব্য-প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বকে  অস্বীকার করতে পারি না।

ঋণ স্বীকার : কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত।