ধ্রুপদী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত - (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম
বিশ - ত্রিশ বছর ধরে জ্ঞানত গদ্য-পদ্যের নির্বিরােধ পরিণতি চাওয়ার ফল স্বরূপ, তাঁর গদ্য-কবিতা রচনার প্রয়াস, এই কাব্যগ্রন্থে দেখা যায়।
১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ সাল এই চার বছর তিনি প্রায় কিছুই লেখেননি। সময় কেটেছে তার পুরনাে লেখার পরিমার্জনে। তিনি নিজের কবিতা কিংবা অনুবাদের সংস্কারে অনমনীয় ভাবে অটল ছিলেন। এ কারণে ধূর্জটি প্রসাদ মুখােপাধ্যায় একবার রসিকতা করে তাঁকে বলেছিলেন, 'সুধীন্দ্রনাথের দুর্বলতা, তিনি Incompetent কবি হতে লজ্জ্বা পান।' তারপরেই তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, ‘লজ্জ্বাটা স্বাভাবিক, কিন্তু এ'লজ্জ্বার পিছনে একটা চিত্তশুদ্ধি এবং কবিতার রূপ সম্বন্ধে একটা মোক্ষম ধারণা আছে, যার উৎপত্তি বােধহয় মালার্মে, ভ্যালেরী প্রভৃতির কবিতা ও কবিতা সংক্রান্ত মতামতে।' সুধীন্দ্রনাথ যেমন কবিতা পরিমার্জনে বিশ্বাসী ছিলেন, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তেমন ঠিক এর বিরুদ্ধাচারী ছিলেন। তিনি কবিতার পরিমার্জনে বিশ্বাসী করতেন না।
সুধীন্দ্রনাথের আরও বিশ্বাস ছিল, উচ্ছ্বাস কবিতার ভীষণরকম ক্ষতি করে। প্রচলিত শব্দ ব্যবহারও, তিনি তাঁর কবিতায় সতর্কভাবে পরিহার করে চলতেন।
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রেরণার প্রতি সম্পূর্ণরূপে আস্থাহীন ছিলেন না। তাঁর ধারণায় অভিজ্ঞতাই কাব্যের মৌলিক উপাদান। গতানুগতিক কাব্য রচনায় তাঁর অনীহা ছিল। তাঁর কথায় 'সাহিত্য সংক্রান্ত সামান্যীকরণে পর্যন্ত আমি সচরাচর এক চক্ষু হরিণ হলেও কচিৎ-কদাচিত হটকারীও বটে।'
এই জন্যই বােধহয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা কবিতার আসরে বিশিষ্ট এবং স্বতন্ত্র। মনীষা এবং সচেতন কারুকৃতির অন্যতম পথিকৃত।
উল্লেখিত ছ'টি কাব্যগ্রন্থ ছাড়া (তন্বী, অর্কেস্ট্রা, ক্রন্দসী, উত্তর ফাল্গুনী, সংবর্ত, দশমী) তার মাত্র দুটি উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
১। স্বগত (ভাৱতী ভবন) ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত।
২। কুলায় ও কালপুরুষ (সিগনেট প্রেস) ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত।
প্রবন্ধগুলি পড়লেই বােঝা যায়, মেধা ও মননশীলতা তাঁর কত গভীর ছিল। কবিতার মতাে তার প্রবন্ধের গদ্যরীতিও তিনি পাঠকের কাছ স্বাতন্ত্রের দাবী রাখেন । প্রসঙ্গত কমলকুমার মজুমদারের গদ্যরীতির কথা মনে পড়ে যায়।
তিনি প্রাচ্য ও পশ্চাত্যের শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। হয়তাে ব্যক্তি জীবনে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যপনার সুবাদে তিনি এ ব্যাপারে অনুসন্ধিসু ছিলেন।
বুদ্ধদেব বসুর কাছে জানতে পারি, 'সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন, বহুভাষাবিদ পণ্ডিত মনস্বী, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী বুদ্ধির অধিকারী, তথ্যে ও তত্ত্বে আসক্ত, দর্শনে ও সংলগ্ন শাস্ত্র সমূহে বিদ্বান, তাঁর পঠনের পরিধি ছিল বিরাট ও বােধের ক্ষিপ্রতা ছিল অসামান্য' সেই সঙ্গে যাকে বলে কান্ডজ্ঞান সাংসারিক ও সামাজিক সুবুদ্ধি , তাও পূর্ণ মাত্রায় ছিল তাঁর, কোনাে কর্তব্যে অবহেলা করতেন না।
গার্হস্থ্য ধর্মপালনে অনিন্দ্যনীয় ছিলেন, ছিলেন আলাপদ, রসিক, প্রখর ব্যক্তিত্বশালী, আচরণের পুঙ্খানুপুখে সচেতন এবং সর্ব-বিষয়ে উৎসুক ও মনােযােগী।'
নিন্দুকদের মতে তাঁর কবিতা ‘সংস্কৃত আর ইংরেজী ভাষার বর্ণসংকর ঘটিয়ে অস্পৃশ্য রচনারীতির জন্ম দিয়েছে, বঙ্গ ভাষার নাট মন্দিরে সে হরিজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আক্ষেপ করে বলেছেন, কবি প্রতিভার অভাব এবং তার বিরূপ পরিমণ্ডল কবির পক্ষে অভিশাপ।
তিনি কখনােই প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতাে জনতার কবি হতে চান নি। তিনি স্বীকার করেছেন 'বস্তুত আমি নিরবধিকাল বা বিপুল পৃথ্বীর অনুগ্রহকাঙ্খী নই, সমানধর্মী সহানুভূতিই আমার একান্ত কাম্য।'
তাঁর লেখা কবিতা দুরূহ বলে নিন্দিত হলেও, তাকে অগ্রাহ্য করার মতাে স্পর্ধা, কখনােই কারাের হয়নি।
সকলেই করি নয়, কেউ কেউ কবি'- জীবনানন্দ দাশের এ'কথার সত্যতা তিনিও মানতেন । কিন্তু দু'জনের মধ্যে ভাবাদর্শে আসমান-জমিন ফারাক ছিল। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন স্বভাবে আবেগ প্রবণ কবি, অর্থাৎ যাকে কি না বলে 'স্বভাব-জাত' কবি। আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন মেধা ও মনন সম্পন্ন কবি অর্থাৎ কি না বােধ-বুদ্ধি গ্রাহ্য, সচেতন কাব্য-কারু কর্মী।
গল্পকার কমলকুমার মজুমদারের মতাে তারও আত্মশ্লাঘা ছিল যে তাঁর লেখা বুঝবার জন্য পাঠককেও পরিশ্রমী হতে হবে। নিজেকে যােগ্য করে তুলতে হবে পাঠক হিসাবে। পিটুলী গােলা-গেলা পাঠক, তিনি অপছন্দ করতেন। তিনি জানতেন, সকলে তার লেখা বুঝতে
পারবেন না। তার লেখার রস গ্রহণ করার জন্য পাঠককেও মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। থাকতে হবে মননশীলতা এবং কাব্যানুরাগ। তা তিনি তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে প্রত্যাশা করতেন।
তাঁর সমানধর্মী অনুভূতিশীল পাঠকেরই একান্ত কামনা করতেন। কবিতাকে তিনি দূরত্ব দান করেছিলেন ইচ্ছাকৃতভাবে, যাতে সে দূরত্ব কাব্য পাঠকের চেতনাকে নাড়া দিয়ে সতর্ক করে। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, 'আমাদের মধ্যে লেখা পড়ার অসামঞ্জস্য বিস্ময়কর ; এবং তার ফলে বাংলা প্রবন্ধই বিপদগ্রস্ত নয়, বাংলা কাব্যও অসংলগ্ন ভাবচ্ছবির অনিকাম সংঘট্ট।'
তিনি যেমন কাব্য রচনার ক্ষেত্রে অক্লান্ত মনােযােগী ছিলেন, পাঠকের কাছেও তা প্রত্যাশা করতেন।