ধ্রুপদী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত - (চতুর্থ পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                     বুদ্ধদেব বসুর কথায় জানতে পারি,'তিনিই একমাত্র কবি, যিনি বাংলা ও বাংলায় ব্যবহার যােগ্য প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের নির্ভুল বানান জানতেন, এবং শব্দতত্ব ও ছন্দশাস্ত্র বিষয়ে যাঁর ধারণায় ছিল জ্ঞানাশ্রিত স্পষ্টতা। এই শব্দের প্রেমিক শব্দকে প্রতিটি সম্ভবপর উপায়ে অর্জন করেছিলেন ; জীবনব্যাপী সেই সংসর্গ ও অনুচিন্তনের ফলেই সম্ভব হয়েছিল 'দ্বিধা-মলিদা’ বা ‘গুরু-অগুরু’- মতাে বিস্ময়কর অথচ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অন্ত্যানুপ্রাস।'

- " রহস্যের অনড় অভিধা
মুকুরিত সরোবরে, হতবাক দ্রুমে
প্রবিষ্ট নিবিড় ছায়া, বহিরঙ্গে বিশীর্ণ মলিদা;
অবলুপ্ত জনপদ ইন্দ্রনীল ধূমে,
ঘরে ঘরে প্রদোষের দ্বিধা।
- “অগ্রহায়ণ" (কবিতা)।

                  এখানে 'মলিদা' মানে সূক্ষ্ম পশমী শীতবস্ত্র।
তখন তাঁর কবিতার যথার্থ দুরূহতার কারণ বােঝা যায়। অবান্তরকে বর্জনের উদ্যোগ মধুসূদনের মতাে তাঁরও ছিল স্বাভাবিক প্রবণতা।
            গতানুগতিক কবিতা রচনায় প্রথম থেকেই তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি কবিতার পরিমার্জনে বিশ্বাসী ছিলেন। কাব্য প্রকাশে তিনি নতুনত্বের সাহায্যে পাঠকের চৈতন্যকে জাগিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রবাহমান ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেই কবিতার রূপান্তর সম্ভব, এ কথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তার কাব্য ভাবনা, ‘উক্তি ও উপলব্ধির' সাযুজ্য সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। কাব্য রচনায় তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম অনুধাবনীয়।
            তিনি বলতেন, কবির উদেশ্য তার চারপাশের অবিচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতণ্যের উদ্ভাবন।'
           তিনি বুঝতেন, ‘অন্তপুরে বসে রূপকথার রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখা কাব্যের কাব্য-কথা আর চলবে না। তাকে বেরিয়ে আসতে হবে, পােকায়া-খাওয়া শিরােপা, মরচে-পড়া সাঁজোয়া, রজ্জুসার জয়মাল্য ফেলে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে হাটের মাঝে, যেখানে পাপ-পুণ্য, ভালাে-মন্দ, দেব-দানব সমস্বরে জটলা পাকাতে ব্যস্ত।
তার মতে ‘মহাকবি তিনিই, যিনি দৃশ্যমান বস্তুমাত্রের প্রচ্ছন্ন উদ্দীপনা শক্তিকে নিজের শরীরে ধরে, সেই দুর্বল উত্তেজনাকে অনুকূল ঘটনা চক্রের অনুগ্রহে, পাঠকের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে দেন... কাব্য রচনার উপলক্ষে কোনও অলৌকিক প্রেরণা কবিকে পেয়ে বসে না।' তিনি বলতেন নির্বিরােধ-ন্যায়ের সত্য আদর্শই মহৎ কাব্যের প্রধান উপজীব্য।'
                  তিনি মনে করতেন ‘যখন সাহিত্য আর সংবাদপত্রের মধ্যে কোনও ব্যবধান থাকে না, তখন মন প্রাণ, বা আত্মিক সম্পদের জন্য গৌরববােধ কবির কর্তব্য নয়, তার আরাধ্য মাত্রা - জ্ঞান আর তন্ময়তা।'

                    কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রধানতঃ দুঃখবাদের প্রবক্তা। প্রসঙ্গতঃ তার ভাষায়- 'কৃত্রিম কল্পনা ত্যাগ, নিরাসক্ত অসাধ্য সাধন, অনন্ত প্রস্থান মিথ্যা, সত্য শুধু আত্ম পরিক্রমা।'
                     মােহিতলাল আবার বলেছেন,'সত্য শুধু কামনাই মিথ্যা চিরমরণ পিপাসা।'  যতীন্দ্রমােহন সেনগুপ্ত, মােহিতলাল মজুমদার এরাও দুঃখবাদী কবি। তফাৎ শুধু এদের শিকড় ভারতীয় দুঃখবাদী দর্শনে প্রােথিত, আর সুধীন্দ্রনাথের দুঃখবাদের আশ্রয়-বােদলয়ের, মালার্মে, ভ্যালেরী প্রভৃতি কবিদের কাছে।
                     ‘ক্রন্দসী’-তে যে সব কবিতা সংকলিত হয়েছে, তাতে দুঃখবাদ ও হতাশীর ক্ষরণ লক্ষ্যণীয়।
      নরক' কবিতায় তার শূন্যবাদী দর্শনের চিত্ররূপময়তা-

‘ জীবনের সার কথা পিশাচের উপভােগ্য হওয়া
নির্বিকারে, নির্বিবাদে সওয়া
শবের সংসর্গ আর শিবার সদভাবে।'

এরপরে কবি সিদ্ধান্তে আসেন -

‘অমেয় জগতে
নিজস্ব নরক মোর বাঁধ ভেঙে ছড়ায়েছে আজ
মানুষের মর্মে মর্মে করিছে বিরাজ
সংক্রমিত মড়কের কীট,
শুকায়েছে কালস্রোত ; কর্দমে মেলে না পাদপীঠ
অতএব পরিত্রাণ নাই
যন্ত্রণাই জীবনের একমাত্র সত্য, তারই নিরুদ্দেশে
আমাদের প্রাণ যাত্রাসাঙ্গ হয় প্রত্যেক নিমেষে।'