ছন্দ জয় মন্দ নয়
শংকর ব্রহ্ম
[ক].
--------------------------------------
গায়ত্রী ছন্দ
--------------------------------------
গায়ত্রী ছন্দে আটটি শব্দাংশ-যুক্ত মোট তিনটি পাদ থাকে। কিন্তু ঋগ্বেদ সংহিতায় উল্লিখিত গায়ত্রী মন্ত্রে একটি শব্দাংশ কম। এই মন্ত্রের প্রথম পাদে সাতটি শব্দাংশ। তাই তিন-শব্দাংশযুক্ত "বরেণ্যং" শব্দের পরিবর্তে "বরেণীয়ং" শব্দটির দ্বারা শব্দাংশের সংখ্যায় সমতা আনা হয়।
[খ].
--------------------------------------
মন্দাক্রান্তা ছন্দ
--------------------------------------
মন্দাক্রান্তা ছন্দ সতেরো অক্ষরের। এই শ্রেণীর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এর প্রতি পঙক্তির বর্ণগুলি লঘু-গুরু ক্রমে নির্দিষ্ট ক্রমে বিন্যস্ত হয়ে থাকে। প্রতি পঙক্তির বর্ণসংখ্যা এবং লঘু-গুরু ক্রমে বিন্যাসের বৈচিত্রভেদে রচিত প্রত্যেকটি ছন্দ এক-একটি বিশেষ নামে পরিচিত হয়ে থাকে।
[গ].
--------------------------------------
অনুষ্টুপ ছন্দ
--------------------------------------
অনুষ্টুপ ছন্দে চারটে করে চরণ থাকবে আর তার প্রতিটি চরণ থাকবে আটটা অক্ষর।প্রত্যেক চরণে ষষ্ঠ অক্ষর গুরু হবে আর পাঁচ নং হবে লঘু। সপ্তম অক্ষর প্রথম এবং তৃতীয় চরণে গুরু হবে আর দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণে হ্রস্ব হবে ।
এবার দেখা যাক ‘গুরু’ এবং ‘লঘু’ বলতে কী বোঝায়। স্বরবর্ণের --- অ- ই-উ-ঋ-ঌ : হল লঘু বর্ণ এবং আ-ঈ-এ-ঐ-ও-ঔ –ৠ-ৡ : হ’ল গুরু বর্ণ। এছাড়াও কিছু ব্যতিক্রম ও আছে। আমরা যদি এর একটা ছক তৈরি করি , তা হ’বে এ রকমঃ-
শব্দাংশ
১
২
৩
৪
৫
৬
৭
৮
প্রথম চরণ
-
-
-
-
লঘু
গুরু
-
-
দ্বিতীয় চরণ
-
-
-
-
লঘু
গুরু
লঘু
-
তৃতীয় চরণ
-
-
-
-
লঘু
গুরু
-
--
চতুর্থ চরণ
-
-
-
-
লঘু
গুরু
লঘু
-
[ঘ].
--------------------------------------
তোটক ছন্দ
--------------------------------------
তোটক ছন্দ” হচ্ছে সংস্কৃত বৃত্ত ছন্দের অর্ন্তগত একটি ছন্দ। সংস্কৃত ছন্দ সৃষ্টি হয় লঘু ও গুরু অক্ষরের সুপরিকল্পিত বিন্যাসের দ্বারা। লঘু অক্ষর উচ্চারণের সময় কম তাই ১ মাত্রা, আর গুরু অক্ষর উচ্চারণের সময় বেশী তাই ২ মাত্রা।
সংস্কৃত তোটক ছন্দের গঠন - (লঘু+লঘু+গুরু)+(লঘু+লঘু+গুরু)+(লঘু+লঘু+গুরু)+(লঘু+লঘু+গুরু)
এটাকে বাংলা ছন্দের সাথে মিলিয়ে দেখলে, সংস্কৃত ছন্দের লঘু অক্ষর হলো বাংলা ছন্দে মুক্তাক্ষর, আর সংস্কৃত ছন্দের গুরু অক্ষর হলো বাংলা ছন্দে রুদ্ধাক্ষর (স্বাভাবিক ভাবে)। সংস্কৃত “তোটক” ছন্দকে বাংলায় করতে আমরা মুক্তাক্ষর ও রুদ্ধাক্ষর ধরে করবো।
তাহলে বাংলা ছন্দের মুক্তাক্ষর ও রুদ্ধাক্ষর অনুযায়ী -
“তোটক ছন্দ” সাজাই- (মুক্ত+মুক্ত+বদ্ধ)+(মুক্ত+মুক্ত+বদ্ধ)+(মুক্ত+মুক্ত+বদ্ধ)+(মুক্ত+মুক্ত+বদ্ধ)।
(অর্থাৎ- তা তা ধিন্ তা তা ধিন্ তা তা ধিন্ তা তা ধিন্)
স্বর-বিন্যাসের মজা
----------------------------
আমরা যে কথা বলি, কবিতা আবৃত্তি করি, গান করি, এমন কি কাঁদি তা কিছু স্বর বা ধ্বনির বিন্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। এই স্বরের বিন্যাস কেমন, তা নিয়েই এই আলোচনা।
প্লুতস্বর
---------------
যে স্বরধ্বনিকে টেনে টেনে দীর্ঘ বা প্রলম্বিত করে উচ্চারণ করা হয়, তাকে প্লুতস্বর বলে। গানে, কান্নায় কিংবা দূর থেকে কাউকে ডাকলে প্লুতস্বরের সৃষ্টি হয়।
মুক্তস্বর ও বদ্ধস্বর
--------------------------
মাত্রা বা দল বা স্বর হচ্ছে তাই, যা আমরা পদ্যকে পাঠ বা আবৃত্তির সময় এককভাবে ও একদমেই সর্বনিম্ন স্বরভিত্তিক উচ্চারণ করে থাকি। ইংরেজিতে একে Syllable বলা যায়। যেমন সিলেবল শব্দটি উচ্চারণে আমরা কয়টি দম নিই? আমরা একে তিনদমেই পড়ি, সি+লে+বল। ফলে এতে স্পষ্ট হয় তিনটি মাত্রা। কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় যে, সি আর লে হচ্ছে একটি একক বর্ণের স্বর বা মাত্রা যা উচ্চারণে মুখ দিয়ে অবারিত বাতাস বের হয়। এসব মাত্রাকেই বলা হয় মুক্তস্বর। আর বাকি বল শব্দটি দু'বর্ণের একটি যৌথস্বর যাকে ভেঙে উচ্চারণ করা যায় না, এককভাবেই উচ্চারিত হতে বাধ্য। কিন্তু একে উচ্চারণ করতে গেলেই অবারিত বাতাস বের হতে পারে না বরং জিহবা থামিয়ে দেয়। একেই বলি আমরা বদ্ধস্বর।
পদ্যের মাত্রা এই দু'স্বর দিয়েই গঠিত হয়।
এবার বোঝার জন্য দু'প্রকার স্বরবিন্যাস দেখা যেতে পারে।
জসীম উদ্দীনের কবর কবিতার একটি পঙক্তি দেখি এবং মুক্ত ও বদ্ধস্বর খুঁজি।
'এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে'।
এখানে আছে ৮টি মুক্তস্বর এবং ৬টি বদ্ধস্বর। যারাই এই মাত্রার পরিসংখ্যানের সাথে একমত হবেন, তারাই মাত্রা বুঝে গেছেন বলে ধরা যায়। আর না বুঝলে বারবার পড়ুন। যখন দেখবেন বুঝতে পেরেছেন, তখন মজা পাবেন।
তোটক ছন্দ- এখানে একটু খেয়াল করে দেখলে, দেখবেন- সংস্কৃত ছন্দের মতো মুক্তাক্ষরকে ১ মাত্রাও রুদ্ধাক্ষরকে ২ মাত্রা ধরে হিসাব করলে ১৬ মাত্রা পাওয়া যাবে।
এটা এক চরণের হিসাব, এই ভাবে প্রতি চরণে একই নিয়ম রক্ষা করে মুক্তাক্ষর ও রুদ্ধাক্ষর স্থাপন করতে হবে।
ফলে মুক্তাক্ষর ও রুদ্ধাক্ষর এর নিজ নিজ সংখ্যা সমান থাকে। এটা স্বরমাত্রিক ছন্দের মতো স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের চরণের দৈর্ঘ্যও মাপা যায়। যা আপনি নীচের কবিতাটিতে দেখতে পাবেন।
এবার আমরা নীচের এই কবিতায় “তোটক ছন্দ” মাপবো। এখানে খেয়াল করে দেখবেন- প্রতি চরণে মুক্তাক্ষর ও রুদ্ধাক্ষর এর নিজ নিজ সংখ্যা সমান আছে।
বাংলা ছন্দে মুক্ত ও রুদ্ধ অক্ষরের এই বিচিত্র ও নিয়মিত বিন্যাসে নিম্নের কবিতাটি “তোটক ছন্দে” রচনা করা হয়েছে।
" ব/হু/কাল/ আ/গে/ এক/ বি/চা/রক/ ম/হো/দয়,
আ/প/নার /কৃ/ত/কর/মে/পে/লেন/ ম/হা/ভয়।
ক/ত/ আর/ ক/রা/ যায়/ সে/জে/ নট/ মি/ছে/ কাজ,
স/ক/লের/ মা/ঝে/ কর/ছে /অ/সত/ত/ বি/রাজ।
লো/কা/লয়/ ছে/ড়ে/ তাই/ ব/নে/ কর/লো /গ/মন,
গা/য়ে/ তার/ ঋ/ষি/বেশ/ সা/ধ/নের/ ত/রে/ মন।
দে/খে/ বন/ সু/শী/তল/ সু/নি/বিড়/ চা/রি/ধার,
ধ্যা/নে/ বস/লো /প্র/ভুর না/মে /নাই /কে/হ/ আর।
সা/রা/দিন/ সা/রা/রাত/ ক/রে/ জপ/ বি/ধা/তার,
ক্ষু/ধা/বোধ/ হ/লে/ ফল/ ছিঁ/ড়ে/ কর/ত/ আ/হার।
নি/রা/সক/ত/ ঋ/ষির/ কে/টে/ যায় /কি/ছু/কাল,
প্র/ভু/ ক/য়,/ 'সা/ধ/নার/ পু/রো/টাই/ হ/লো/ জাল'।
বি/ধা/তার/ বা/ণী /শূল/রূ/পে/ বিঁধ/ল/ আ/মার,
ম/নে/ জাগ/ল/ প্র/ভুর/ এ/ কে/মন/ অ/বি/চার!"
সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়নের প্রথম সোপান হল লঘু গুরু নির্ণয়ের নিয়ম জানা। এই লঘুত্ব বা গুরুত্ব স্বরবর্ণেরই ধর্ম।
আমরা এবার স্বরবর্ণেরই লঘুত্ব গুরুত্ব নির্ণয় করব। নীচে লঘু গুরু নির্ধারণের নিয়মগুলি সংক্ষেপে প্রয়োগমূলক ভাবে দেওয়া হল –
১). হ্রস্বং লঘু – অ,ই,উ,ঋ এই হ্রস্ব বর্ণগুলি লঘু বলে অভিহিত হয়।
২). সংযোগে গুরু – হ্রস্ব বর্ণের পরে সংযুক্ত বর্ণ থাকলে হ্রস্ব বর্ণটি গুরু বলে বিবেচিত হবে। তাই হ্রস্ব বর্ণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সংযুক্ত বর্ণের পূর্ববর্তী স্বরবর্ণই গুরু হয়। সংযুক্ত বর্ণ বলতে মাঝে স্বরবর্ণের ব্যবধান না থাকা দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনবর্ণকে বোঝায়। যেমন – প্রজ্ঞা। প্র অর্থাৎ প্ র্ অ – এখানে শেষে বিদ্যমান স্বরবর্ণ অকার গুরু হবে, কারণ পরে জ্ঞ - জ্ ঞ্ অ – একটি সংযুক্ত বর্ণ, কারণ জ্ এবং ঞ্ এই দুই ব্যঞ্জনবর্ণের মাঝে কোনো স্বরবর্ণ নেই।
৩) . সানুস্বার, বিসর্গান্ত – অনুস্বার ও বিসর্গযুক্ত স্বরবর্ণ গুরু হবে। যেমন রামঃ বা রামং এখানে মগত(ম্ অ) অকারের পরে বিসর্গ বা অনুস্বার থাকার জন্য অকার গুরু হবে। অনুস্বার এর স্থানে যদি ম থাকে তাহলেও তৎসংযুক্ত স্বরবর্ণ গুরু হবে।
৪). প্রহ্রে বা – হ্রস্ববর্ণের পরে সংযুক্ত বর্ণ প্র বা হ্র থাকলে প্রয়োজনবশতঃ হ্রস্ববর্ণ লঘু বলেও বিবেচিত হয়। এটা শুধু প্র ও হ্র এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তাও আবার প্রয়োজনবশতঃ। অর্থাৎ প্রয়োজন না থাকলে সাধারণ নিয়মানুসারে প্র ও হ্র এর পূর্ববর্তী হ্রস্ববর্ণ লঘুই হবে।
৫). দীর্ঘং চ – আ,ঈ,ঊ,এ,ঐ,ও,ঔ এই দীর্ঘ বর্ণগুলি গুরু বলে অভিহিত হয়।
৬). পাদান্তে বিদ্যমান লঘুবর্ণও প্রয়োজনে গুরু হতে পারে আবার গুরুবর্ণও প্রয়োজনে লঘু হতে পারে।
এবার আসুন জানি দশগণ কি?
------------------------------------------
ছন্দ অধ্যয়নের দ্বিতীয় সোপান হল দশগণের জ্ঞান।
ম,য,র,স,ত,জ,ভ,ন,গ,ল –
এই দশটি গণের জ্ঞান থাকা জরুরী।
ম গণে তিনটি স্বরবর্ণই গুরু হয়,
ন গণে তিনটি স্বরবর্ণই লঘু হয়,
ভ গণে আদিস্বর গুরু,
য গণে আদিস্বর লঘু,
জ গণে মধ্যস্বর গুরু,
র গণে মধ্যস্বর লঘু,
স গণে অন্ত্যস্বর গুরু,
ত গণে অন্ত্যস্বর লঘু।
গ গণে একটি স্বর থাকে এবং সেটি গুরু,
ল গণে একটি স্বর থাকে এবং সেটি লঘু।
সংক্ষেপে
গণগুলির বিবরণ নিম্নরূপ –
ম - ত্রিগুরু
ন – ত্রিলঘু
ভ – আদিগুরু
য – আদিলঘু
জ – মধ্যগুরু
র – মধ্যলঘু
স – অন্ত্যগুরু
ত – অন্ত্যলঘু
গ – একটি গুরু
ল – একটি লঘু।
উদাহরণ:
"ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃপাণ্ডবাশ্চৈব কিংকুর্বত সঞ্জয় ।”
ধর্— গু, ম-- গু, - ক্ষে-- গু - ত্রে -- গু
কু-- ল, রু-- গু, ক্ষে--গু, ত্রে--গু
স- ল, ম- গু, বে- গু, তা—গু,
য়ু-ল, যু-গু, ত- গু, স- ল, বঃ -- গু
একই ভাবে পরের চরণটি হবে।
[ঙ].
--------------------------------------
অমিত্রাক্ষর ছন্দ
--------------------------------------
অমিত্রাক্ষর ছন্দের আক্ষরিক মানে হল চরণান্তে ধ্বনির মিলহীনতা।
মিল্টনের ব্ল্যাঙ্ক ভার্স অবলম্বনে মাইকেল মধুসূধন দত্ত সর্বপ্রথম এই ছন্দের ব্যবহার করেন তার 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্যে, তারপর 'মেঘনাদবধ' কাব্যে এবং 'পদ্মবতী' কাব্যে তা ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যের এক নব দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
১).
অমিত্রাক্ষর ছন্দে ৮+৬,৮+১০,১০+৮ মাত্রার রূপ দেখা যায়।
২).
এই ছন্দের ভাব চরণ থেকে চরণান্তে প্রভাহিত হয় মানে ভাবের প্রবাহমানতা বজায় থাকে, যা পয়ারে নেই।
৩).
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর সুর ও মাত্রা নির্ণয় রীতি অক্ষরবৃত্তের মতো, অর্থাৎ পদান্তে হলান্ত,একাক্ষর সমাসবদ্ধ শব্দ আর দ্বিমাতৃক বাকি সকল ক্ষেত্রে রুদ্ধদল ও মুক্তদল একমাতৃক হয়।
৪).
এই ছন্দের ছেদ ও যতির স্বাধিন ব্যবহার দেখা যায়। এখানে হ্রস্বযতি এবং দীর্ঘযতির যেমন নির্দিষ্ট স্থান আছে, তেমন ছেদ অর্থাৎ বাক্যের সুনিয়ন্ত্রিত কালান্তর দেখা যায়।
৫).
অমিত্রাক্ষর-এর আক্ষরিক অর্থ চরণান্তে অমিল হলেও বা বাহ্যিক লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায় দেখা যায় চরণান্তে মিল থেকেও ভাবের প্রবাহমানতা বজায় থাকে।