বিস্মৃত এক কবির স্মৃতিচারণ - (তৃতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


          কোমলে কঠোরে, তার কবিতা বিচিত্র-রূপীনী। অরণ্য হোক প্রকৃতিই হোক, কিংবা মানুষের প্রতিদিনের আনন্দ বেদনাই হোক, তাঁর লেখনীর যাদুস্পর্শে আমাদের পরিচিত জীব ও জগৎ এক অপরূপ সত্তায় রূপায়িত হয়েছে। অভিনব রূপকল্প নির্মাণে তাঁর সমকক্ষ কবি দুর্লভ।

অশোক বিজয় রাহার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০।
সেগুলো হলো -
১). ডিহাং নদীর বাকে (১৯৪১ সাল),
২).রুদ্র বসন্ত (১৯৪১ সাল),
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় তিনটি কাব্যগ্রন্থ।
৩).জলডম্বরু পাহাড় (১৯৪৫ সাল),
৪). রক্ত সন্ধ্যা (১৯৪৫ সাল),
৫).শেষ চূড়া (১৯৪৫ সাল),

৬).‘উড়ো চিঠির মাঠ’(১৯৫১ সাল),
১৯৬১ সালে
৭).‘সেথা এই চৈত্রের শালবন’(১৯৬১ সাল).
১৯৮১ সালে দু'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়
৮).‘ঘণ্টা বাজে (১৯৮১ সাল).,
৯).পর্দা সরে যায় (১৯৮১ সাল).
এবং ১৯৮৪ সালে
১০).‘অশোক বিজয় রাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়।

             গদ্যও লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা প্রথম গদ্যগ্রন্থ ‘বাণী শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। ‘পত্রাষ্টক’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি 'হিরণ কুমার বসু স্মারক বক্তৃতা' করেন। ভাষণটি একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সমালোচনা হিসেবে গ্রন্থভূক্ত হয়েছে। ‘কবিতার শিল্পরূপ’ নিবন্ধে কবি অশোক বিজয়ের কাব্যদর্শন ও কবি ভাবনা বিধৃত হয়ে আছে। কবিতার আঙ্গিক ও বৈচিত্রতা অশোক বিজয় রাহাকে রূপদক্ষ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুভূতির সূক্ষè রূপায়ন তাঁর কবিতায় স্বার্থভাবে বিধৃত হয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে তিনি বিভিন্নস্থানে অবস্থান করলেও তাঁর কবিতার শিল্পরূপ ছিল বর্তমান।

" একদিন বহু আগে পৃথিবীর আদিম জঙ্গলে
উঠেছে প্রকান্ড সূর্য। দীর্ঘ এক অজগর-রাত
হঠাৎ উঠেছে ন’ড়ে পাকে-পাকে ছাড়ায়ে কুণ্ডলী
আঁকা-বাঁকা ছায়াপথে টেনে তা’র বিসর্পিল দেহ
লুকায়েছে পশ্চিম-সাগরে।

এদিকে সকাল বেলা
সবুজ বনের শাখা পাখিদের কোলাহলে ভরা,
নানা আলোছায়া থেকে বেরিয়েছে হরিণের দল-
বিচিত্র রঙের রামধনু, মাটির ঘাসের বুকে
উড়েছে অসংখ্য প্রজাপতি; ফুটন্ত ফুলের ডালে
ভ্রমরেরা জুড়েছে গুঞ্জন।

তবু এ-সবের ফাকে
ক্ষণে ক্ষণে আতঙ্কিত ত্রাস, -ওদিকে পাহাড় ভেঙ্গে ছুটেছে
উন্মুক্ত হ’য়ে খড়গনামা প্রকাণ্ড গণ্ডার,
খাগের বনের ধারে চকচকে বাঘ-চাটা জল
হঠাৎ উঠেছে জ্ব’লে ঝকঝক আয়নার মতো।
একধারে নেমে আসে হুড়মুড় মহিষের পাল
লাল-চোখ অদ্ভুত মাতাল, -সহসা বিছুটি বনে
এস্তপায়ে লুকায় গোসাপ, -দূরের জঙ্গল থেকে
বার দুই শোনা যায় চিতার করাত-চেরা ডাক। "
(চিরজীবী, শোষ-চূড়া)

                তাঁর শৈশব কাটে সিলেট কাছাড়ের বিভিন্ন জায়গায়। ফলে তাঁর কবিতা চিত্রবহুল।
             নদী, পাহাড়, অরণ্যের প্রকৃতি শুধু তাঁর কবিতার পরিবেশমাত্র নয়, তাঁর কেন্দ্রভূমি । স্বল্পবাক, বর্ণাঢ্য চিত্র তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট ।
          প্রকৃতি ও জীবজন্তুকে এক সুতোয় গেয়েছেন তিনি কবিতায়। দীর্ঘ পংক্তিমালায় কল্পনা এবং বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ভিন্নধারার।
             অশোক বিজয় রাহার কবিতা পর্যালোচনা করলে অপূর্ব শিল্প দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি তাঁর কাব্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা হিন্দি, ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনিশ ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অন্নদাশঙ্করের জীবনসঙ্গিনী লীলা রায় অনুদিত তাঁর কবিতার অনুবাদ Enchanted tree বহুল প্রশংসিত।